

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আসন বণ্টনের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় ভোটের লড়াইয়ে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সঙ্গী হতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের একাধিক বৈঠকে নীতিগতভাবে এ সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত। দল দুটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হুট করেই এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের ছয় নেত্রীকে ফেসবুকে একটি ছবি আপলোড করদে দেখা যায়। জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনার মধ্যে যে ছবি জন্ম দেয় আগ্রহের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বাসায় এক বৈঠকে অংশ নেন এই ছয় নেত্রী। বৈঠকে তারা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া জামায়াত-এনসিপির আসন সমঝোতা নিয়ে ভেটো দেন। তুলে ধরেন নিজেদের মতবিরোধের কথা।
এনসিপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নারী নেত্রীদের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিষয়ে সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। বৈঠকে তারা জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে একযোগে এনসিপি থেকে পদত্যাগের হুমকি দেন। এই নেত্রীরা বিএনপির সঙ্গে জোট বা এককভাবে নির্বাচনের জন্য চাপ দেন নাহিদকে। এ সময় তাদের জানানো হয়, বিএনপির পক্ষ থেকে এনসিপিকে আসন দেওয়ার কথা হলেও তা তারা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছাড় দেবে, দল হিসেবে এনসিপিকে নয়। এমন প্রেক্ষাপটে ও মাঠের পরিস্থিতি বিবেচনায় দলীয় নির্বাহী পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিষয়টি ফের ব্যক্ত করা হয়। তবে উপস্থিত এই নেত্রীরা কোনোভাবেই জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি মানতে চাননি।
আরও জানা গেছে, জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার প্রায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য দলের ভেতর থেকে নেতাদের একাংশ সরাসরি আহ্বায়ক নাহিদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছেন এবং তারা পদত্যাগের হুমকিকে আলোচনার জন্য ব্যবহার করছেন। শুধু এই ছয় নেত্রী নন, এনসিপির একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গে সম্ভাব্য জোট নিয়ে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছেন এবং তারা কোনোভাবেই চান না এই জোট হোক। তবে বিভিন্ন মৌলিক বিষয় ও নির্বাচনী কৌশল হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে এই জোট অনেকটাই নিশ্চিত।
আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বাসায় অনুষ্ঠিত গতকালের আলোচনায় ছিলেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসুম, যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনুভা জাবিন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারোয়ার নিভা। জোটের আলোচনায় শুধু তাসনিম জারার আসন প্রায় নিশ্চিত থাকলেও মনোনয়ন হারানোর শঙ্কায় আছেন তাজনুভা জাবিন (ঢাকা ১৭) এবং নাহিদা সারোয়ার নিভা (ঢাকা ১২)। এ ছাড়া নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে আছেন সামান্তা শারমিন। ঢাকা-১৩ আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। অবশ্য গতকালের বৈঠকে উপস্থিত নুসরাত তাবাসুম দলটির প্রাথমিক মনোনয়নই পাননি।
বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক লক্ষ্য, রাজনৈতিক লাইনআপ, আগামী নির্বাচন ও জোট নিয়ে আহ্বায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। এখানে স্বাভাবিকভাবে জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিষয়েও আমাদের আলোচনা হয়েছে। জোটে গেলে কী লাভ, কী ক্ষতি, আমাদের রাজনৈতিক বয়ান ও দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কী হবে সেসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া দলের সার্বিক বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা কালবেলাকে বলেন, ‘নেত্রীদের একটি অংশ চান না এই জোট (জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতা) হোক। তারা নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছেন। তবে তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে। আশা করি তারা দলের বৃহত্তর স্বার্থটা দেখবেন।’
এই নেতা আরও বলেন, ‘আগামী নির্বাচন, নির্বাচনী কৌশল, সংস্কার, বিচারসহ নানা বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে একমত হয়েছে এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এটা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত। শিগগির হয়তো ঘোষণা আসবে। একটি অংশ এ জোট চাচ্ছে না। তবে সেটি খুব বড় নয়। এ ছাড়া দলের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের একটা গ্রুপ চাচ্ছে, অন্তত ৫০ আসনে সমঝোতা হতে। আশা করি সেটি হবে।’
কালবেলার কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠক হয়েছে এনসিপি নেতাদের। এসব বৈঠকে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেনের নেতৃত্বে এনসিপির একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিল। সভা থেকে সংস্কার, বিচারসহ বেশ কিছু মৌলিক ইস্যুতে একমত হয়েছেন দুই দলের নেতারা। আসন সমঝোতা হলে এনসিপিকে কত আসন ছাড়তে হবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্র বলছে, এনসিপি অন্তত ৫০ আসনের নিশ্চয়তা চায়। তবে জামায়াতে ইসলামী ৩০ আসন দেওয়ার প্রাথমিক আলোচনা করেছে। বৈঠকে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও ৩০-৫০ আসন এনসিপিকে ছাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে এসব আসনে এনসিপির বর্তমান জোট সঙ্গী আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনও থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে এনসিপির অভ্যন্তরে ও বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। জামায়াতের সঙ্গেও হয়েছে। আমরা খুব শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব।’
এনসিপি-জামায়াতের সম্ভাব্য জোটের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘৩০ আসনে এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে জোটে গেলে ব্যাপারটা আত্মঘাতী হবে। এখন পর্যন্ত এনসিপি-জামায়াতের আসন সমঝোতা হচ্ছে না, যা হচ্ছে সেটা নির্বাচনী জোট। জোটের নমিনেশনের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক আহ্বায়ক আবদুল কাদের আরেক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘তারুণ্যের রাজনীতির কবর রচিত হতে যাচ্ছে। এনসিপি অবশেষে জামায়াতের সঙ্গেই সরাসরি জোট বাঁধছে। সারা দেশে মানুষের, নেতাকর্মীদের আশাআকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে গুটিকয় নেতার স্বার্থ হাসিল করতেই এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।’
আলোচনায় থাকা এ জোট প্রসঙ্গে গতকাল জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এনসিপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই জোট গঠনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এখন দেখা যাক কী হয়, জোট হলে আপনাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
মন্তব্য করুন