ঢাকার মহাখালী কড়াইল বস্তির তিন নম্বর সরু গলির শেষ মাথার একটি ঘরে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন রিকশা শ্রমিক মামুন মিয়া। ভোরে পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দেওয়ার পরপরই জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তীব্র গরমে প্রায় নয় ঘণ্টা রিকশা ঠেলে দুপুরে বিশ্রামের জন্য ঘরে ফিরেছেন। কিছুক্ষণ পর ঘামে একাকার হয়ে ফেরেন মামুনের স্ত্রী স্বপ্না। বস্তির ছোট্ট ঘরে বসেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তারা।
স্বপ্না জানান, স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না। তাই বনানীর দুটি বাসায় কাজ নিয়েছেন। সকাল ৭টার দিকে ঘর থেকে বের হতে হয়। কাজ শেষ করে ফেরেন দুপুরে। দুই বাসায় কাজ করে পান ৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘর ভাড়ায় চলে যায় ৩ হাজার টাকা। দুই মেয়ে স্কুলে পড়ে। তাদের পড়াশোনার খরচও চালান স্বপ্না।
রিকশাচালক মামুন বলেন, ‘দুজনে সারাদিন খাটুনির পর যা রোজগার করি, তা দিয়ে সংসার চলে না। তার ওপর প্রচণ্ড রোদে একটানা রিকশা চালাতে পারি না। এ কারণে রোজগারও কমে গেছে। অন্যদিকে সব জিনিসের দাম বেশি। শাকসবজি, আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো—এর উপায়ও নেই। আলুর কেজি ৬০ টাকা। একটা কচুর দাম ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। কচুশাক এখন বড়লোকের খাবার।’
শুধু স্বপ্না ও মামুন নন, দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষেরই এখন একই দশা। ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই চড়া। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত আয়ের ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ মানুষ কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। একই মাসে নিম্ন ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই মজুরির চেয়ে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ০১ শতাংশ বেশি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরেই চলছে মজুরির চেয়ে খরচ বাড়ার এই প্রবণতা।
একদিকে আয়ের চেয়ে খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে রোদের তীব্র তাপ। এর মধ্যে অনেকের আবার নিয়মিত কাজ নেই। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে ভালো নেই নিম্ন আয়ের মানুষ।
গ্রিন রোডে ধানমন্ডি ক্লিনিকের পাশে মার্কেটের সামনে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে জড়ো হন ২৫ থেকে ৩০ জন রংমিস্ত্রি। বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়িওয়ালারা এসে কাজের জন্য নিয়ে যান তাদের। তবে এখানে অপেক্ষায় থাকা সবার কাজ জোটে না প্রতিদিন।
এই শ্রমিকদের একজন বরিশালের মনির হোসেন। থাকেন ঝিগাতলায় একটি ভাড়া বাড়িতে। জানালেন, স্ট্রোক করে বাবা শয্যাশায়ী। স্ত্রীও অসুস্থ। এ ছাড়া আছেন মা, ভাই ও সন্তান। সংসারে অনেক খরচ। কিন্তু মাসে ২০ দিন কাজ থাকলে ১০ দিন থাকে না। দিনে মজুরি পান ৮০০ টাকা। নিয়মিত কাজ থাকলে এই টাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হতো না। বাসা ভাড়া দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম চড়া। ঘরে দুজন অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার খরচ চালাতে খুব কষ্ট হয়। সেইসঙ্গে আছে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ।
গত রোববার সকালে গ্রিন রোডের আনন্দ রেস্টুরেন্টের পাশে কাজের অপেক্ষায় ছিলেন প্রায় ২৫ জন নির্মাণ শ্রমিক। ৯টা পর্যন্ত কাজ পেয়েছেন ১০ জন। হতাশ হয়ে বসে ছিলেন বাকিরা। তাদের একজন রাজশাহীর মাহমুদ। কাজের সন্ধানে ৩০ বছর আগে ঢাকায় এসেছেন তিনি। সেই থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। থাকেন গ্রিন রোডের সার্জেন্ট গলিতে।
মাহমুদ বলেন, ‘দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে ছোট্ট সংসার। ছেলেরা স্কুলে পড়ে। বাসা ভাড়া ৬ হাজার টাকা। যেদিন কাজ পাই আট ঘণ্টা কাজ করলে কখনো ৮০০, কখনো ১ হাজার টাকা মজুরি পাই। মাসে ২০ দিনের মতো কাজ পাই। আবার কোনো মাসে এর চেয়েও কম। সব মিলিয়ে কষ্টের মধ্যে বেঁচে আছি।’
গ্রিন কর্নারের গলিতে ভ্যানগাড়িতে আলু, পটোল, করলাসহ নানা রকম সবজি সাজিয়ে বিক্রি করছিলেন আলী নূর। তাকে সহযোগিতা করছেন স্ত্রী রওশন আরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫৫ বছর বয়সী আলী নূর একটি স্টিল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছেন।
এই দম্পতি জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুর। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আগেই। সবজি বিক্রি করে যা আয় হয় বাকি দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো রকমে দিন চলে যাচ্ছে। টাকার অভাবে ছোট মেয়েকে কলেজে পড়াতে পারেননি তারা।
গুলশান আর মহাখালীর দুটি ক্লিনিকে খণ্ডকালীন কাজ করেন আকলিমা। সব মিলিয়ে মাসে পান ৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘর ভাড়ায়ই চলে যায় আড়াই হাজার টাকা।
আকলিমা বলেন, ‘সকাল-বিকেল দুই ক্লিনিকে কাজ করে যা পাই তাতে এই দুর্মূল্যের বাজারে ঢাকা শহরে চলা খুবই কষ্টকর।’
গত সোমবার রাত ৮টার দিকে পোশাক কারখানায় কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন শাহিদা। তার মতো অনেকেই ধামরাই বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তবে ভিড়ের কারণে কোনো বাসেই উঠতে পারছিলেন না নারী শ্রমিকরা। শেষ পর্যন্ত তিনজন মিলে একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে বাড়ি ফেরেন তারা।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েই কথা হয় শাহিদার সঙ্গে। জানান, তিন বছর ধরে একই কারখানায় কাজ করছেন। সকাল ৮টায় ঢুকতে হয়। ওভারটাইম থাকলে ফিরতে হয় অনেক রাতে। আসার পথে বাসে চড়া সম্ভব হলেও ফেরার পথে পাওয়া যায় না। এজন্য যাতায়াত খরচেই মাসে আড়াই হাজার টাকা চলে যায়। বাসা ভাড়া ৩ হাজার টাকা। মাসের বাজার আর মাছ-তরকারি কিনতেই শেষ হয়ে যায় টাকা।
শাহিদার ভাষ্য, ‘ওভারটাইম মিলিয়ে মাসে বেশি হলে ১৫ হাজার টাকা পাই। স্বামী একটি হোটেলে বেয়ারার কাজ করেন। তার আয়ও ১৫ হাজারের মতো। দুজন মিলে যা রোজগার করি তা দিয়ে নিজেদের সংসারের পাশাপাশি শ্বশুর-শাশুড়িকে চালাতে হয়। সব জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে আমাদের মতো মানুষের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’