অবশেষে যাত্রা শুরু হলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি)। সোমবার ডেনমার্কভিত্তিক কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের জাহাজ ভেড়ার মধ্য দিয়ে টার্মিনালের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান ‘রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল’ গতকাল প্রথমবারের মতো এ টার্মিনালে একটি গিয়ারড কনটেইনার ভ্যাসেল বার্থিং দেয়। একই সঙ্গে তারা শুরু করে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও। দেশের বন্দরগুলোর ইতিহাসে পিসিটিই প্রথম কোনো টার্মিনাল, যেটি পরিচালনা করছে বিদেশি কোম্পানি। এ উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরে গতকাল ছিল নানা আয়োজন-আনুষ্ঠানিকতা। অনুষ্ঠানে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলসহ বন্দর, আরএসজিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই উদ্যোগ। টার্মিনালটি বছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে ৫ লাখ টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের)।
জানা যায়, সৌদি আরবের জেদ্দাভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের (আরএসজিটি) সঙ্গে মাস ছয়েক আগে চুক্তি হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করে রেড সি গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড সোমবার থেকে কাজ শুরু করেছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর একটি ল্যান্ডলর্ড পোর্ট হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করল।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, ‘মায়ের্কস দাবাও’ নামের একটি কনটেইনার ভ্যাসেল আজ (গতকাল) বিকেলে জেটিতে ভেড়ানো হয়। খালাস করা হয় আমদানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও। এ উপলক্ষে আজ বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনালে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী জাহাজটি গত শনিবার দুপুরে মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং হয়ে চট্টগ্রাম এসেছে। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১৮৫ দশমিক ৯৯ মিটার ও ড্রাফট (পানির নিচে থাকা অংশ) ৯ মিটার।
বন্দর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহায়েল জানান, বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গা উপকূলে নির্মিত হয়েছে পিসিটি। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় সৌদি আরবের আরএসজিটি এ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তারা শর্তসাপেক্ষে আগামী ২২ বছর টার্মিনাল পরিচালনা করবে। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর আরএসজিটির সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি হয়। টার্মিনালে এখন কেবল ক্রেনযুক্ত জাহাজই বার্থিং দেওয়া হবে। গ্যান্ট্রি ক্রেন এসে গেলে সব ধরনের জাহাজ বার্থিং দেওয়া হবে।
তিনি জানান, সব সরঞ্জাম সংগ্রহ করে পিসিটি পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে আরও এক থেকে দেড় বছর লাগতে পারে। শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করবে দায়িত্ব পাওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চার্জ পাবে।
পিসিটিতে তিনটি কনটেইনার ও একটি তেল খালাসের (ডলফিন) জেটি রয়েছে। এগুলোতে একসঙ্গে চারটি জাহাজ ভেড়ানো যাবে। কনটেইনার জেটির দুটিতে গ্যান্ট্রি ক্রেন থাকবে। যেখানে ভিড়তে পারবে গিয়ারলেস (ক্রেনবিহীন) জাহাজ এবং অন্যটিতে গিয়ার্ড (ক্রেনযুক্ত) জাহাজ। পিসিটির চারটি জেটিতে একসঙ্গে চারটি জাহাজ বার্থিং নিয়ে পণ্য ওঠানামা করার সুযোগ রয়েছে। ফলে বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজের চাপ কমে যাবে। পণ্য খালাসের অপেক্ষায় জাহাজকে দীর্ঘদিন বসে থাকতে হবে না।
সূত্রমতে, এখানে সমুদ্রের গভীরতা বেশি থাকায় ভেড়ানো যাবে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের জাহাজ। ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়তে পারবে অনায়াসে। এর আগে ২০০ মিটার লম্বা একটি জাহাজ পরীক্ষামূলকভাবে জেটিতে আনা হয়েছিল। পিসিটির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর পর পাচ্ছে নতুন কনটেইনার টার্মিনাল। এর আগে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মিত হয়েছিল ২০০৬ সালে।
কী বলছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা: বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সময় এসেছে বিদেশি অপারেটদের সঙ্গে দেশি অপারেটরদের পণ্য ওঠানামা তুলনা করার। পিসিটি পুরোদমে চালু হলে সেই তুলনা করা যাবে। এতে দেশি অপারেটরদের দক্ষতা কতটা জানা যাবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, পণ্য খালাসে সময় ও অর্থ কতটা সাশ্রয় হচ্ছে এ দুটি বিষয় আমরা নজরে রাখব। কারণ বিদেশি অপারেটর চালুর একটাই লক্ষ্য—বন্দর সেবাকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করা। সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে আমরা আন্তর্জাতিক রপ্তানি পণ্য বাজারেও এগিয়ে থাকব।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বড় জাহাজগুলো কনটেইনার নিয়ে ভেড়ার মাধ্যমে আমাদের আমদানি-রপ্তানির চাহিদা পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। মায়ের্সক লাইনের মতো কোম্পানিগুলো যখন এগিয়ে আসছে, তার মানে নিঃসন্দেহে ভালো কিছুই হবে।
তিন কারণে নজর কাড়বে পিসিটি: বন্দর সংশ্লিষ্টদের মতে, তিন কারণে পিসিটি দেশি-বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারীদের নজর কাড়বে। একটি হচ্ছে, জাহাজ ভেড়াতে অগ্রাধিকার পাওয়া। দ্বিতীয়ত, অন্য যে কোনো জেটির চেয়ে পিসিটির জেটির পাশে নাব্য বেশি; ফলে সবচেয়ে বড় জাহাজও এখানে ভিড়তে পারবে। তৃতীয়ত, বিদেশি অপারেটর হিসেবে আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলোর সঙ্গে কানেকটিভিটি। এ ছাড়া বহির্নোঙর থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বে জেটির অবস্থানও পিসিটিকে অন্য জেটিগুলার চেয়ে এগিয়ে রাখবে।
সিঙ্গাপুর পোর্টে কর্মরত এক শীর্ষ কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশি বার্থ অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটরদের থেকে পিসিটি এগিয়ে থাকবে। এর কারণ—জেটিগুলো তাদের নিজেদের, যন্ত্রপাতি নিজেদের, অপারেশন নিজেদের। আর জাহাজ বরাদ্দ তাদেরই এখতিয়ার। ফলে জাহাজ বরাদ্দে পিসিটি এগিয়ে থাকবেই।
তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর পোর্টে আমরা দেখেছি ভলিউম ডিসকাউন্ট বা রিবেটের বিষয়। বিভিন্ন জাহাজ মালিকদের সঙ্গে সমঝোতা অনুযায়ী টার্গেট পূরণ করতে পারলে বিশেষ ডিসকাউন্টে জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ থাকে; রেড সি গেটওয়ে সেই কৌশল প্রয়োগ করবে। বাংলাদেশি অপারেটররা চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে চুক্তি থাকায় ইচ্ছা থাকলেও সেটি প্রয়োগ করতে পারেননি।
চট্টগ্রাম বন্দরের মেরিন বিভাগের এক পাইলটের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে এনসিটি, সিসিটির নদী পথের দূরত্ব ১১ নটিক্যাল মাইল। কিন্তু পিসিটির দূরত্ব ৮ নটিক্যাল মাইল। ফলে তিন নটিক্যাল মাইল সময় সাশ্রয় হবে। আর কিছুটা কম জোয়ারের পানিতে পিসিটিতে জাহাজ প্রবেশের সুযোগ থাকবে।
জাহাজ ভেড়াতে অগ্রাধিকার পাবে পিসিটি: চট্টগ্রাম বন্দরে এখন জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দরের বার্থিং কোটার নিয়ম মেনে জাহাজ পরিচালনাকারীর চাহিদা দেখা হয়। এরপর কাঙ্ক্ষিত জেটি খালি থাকলে সেখানে জাহাজটি ভেড়ার অনুমতি দেয় বন্দরের মেরিন বিভাগ। কিন্তু পিসিটি হচ্ছে বিদেশি অপারেটর দ্বারা লিজে পরিচালিত। ফলে সেখানে জাহাজ ভিড়তে রেড সি গেটওয়ে কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকার থাকবে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
মেরিন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, জাহাজ ভেড়াতে রেড সির এখতিয়ার থাকবে বেশি। একটি জাহাজ ডেডিকেটেডলি তারা ভেড়াতে পারবে। এর বেশি হলে তারা বন্দরকে জানাবে। তাদের নিজস্ব জাহাজ ভেড়ার পর অন্য জাহাজ সেখানে ভেড়ার সুযোগ পাবে।