ই-কমার্স তথা ডিজিটাল কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা এবং গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষায় ‘ডিজিটাল বিজনেস ইউনিক আইডি’ বা ডিবিআইডি পদ্ধতি চালু করা হয়। দেশের ই-কমার্স বা ডিজিটাল কমার্স ব্যবসা পরিচালনায় নিবন্ধনের মাধ্যমে ডিবিআইডি নেওয়ার বিধান রেখে ‘ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিটি (ডিবিআইডি) নিবন্ধন নির্দেশিকা, ২০২২’ প্রণয়ন করা হয়। তবে চালুর দুই বছরেও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকায় নেই এ ব্যবস্থা। নির্দেশিকা থেকে অদ্যাবধি আইন না থাকায় কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে এই ব্যবস্থা।
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের মধ্যে ডিবিআইডি নিবন্ধনে আবেদনের প্রবণতা কম। যারা আবেদন করছেন তাদের ৮৩ শতাংশই হচ্ছে বাতিল। আবার নিবন্ধন আবেদনের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। একটি ওয়েবসাইটের বিপরীতে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ডিবিআইডি। ফেসবুককে ওয়েবসাইট হিসেবে দেখানো প্রতিষ্ঠানও পেয়েছে নিবন্ধন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল ২০২২ সালের ২৯ জুন প্রজ্ঞাপন আকারে ডিবিআইডি নিবন্ধন নির্দেশিকা, ২০২২ প্রকাশ করে। প্রজ্ঞাপনে এই নির্দেশিকা অনতিবিলম্বে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা, ২০১৮ (২০২০ সালে সংশোধিত) এর অনুচ্ছেদ ৩.৩.৬ অনুসারে ডিবিআইডি নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হয়। এই নির্দেশিকার অনুচ্ছেদ ৩.১ অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) ডিবিআইডির নিবন্ধন, সংশোধন ও সংরক্ষণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। আর নির্দেশিকা ৫.১ অনুযায়ী, ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকির দায়িত্বে থাকবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল। যারা অনলাইনে নিজেদের ওয়েবসাইট ব্যবহার করে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ডিজিটাল ব্যবসা করছেন, তারা এই ডিবিআইডির জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে ডিবিআইডি ব্যবস্থা চালুর দুই বছরেও এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। দেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের সদস্য সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি হলেও ডিবিআইডির জন্য আবেদন করেছে মাত্র ৩০২টি সদস্য প্রতিষ্ঠান। আবার যারা আবেদন করছেন তার বেশিরভাগই বাতিল হচ্ছে।
ডিবিআইডির ওয়েবসাইট মতে, গত ২৪ জুন পর্যন্ত ডিবিআইডির জন্য মোট আট হাজার ৪৭৩টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে এখনো অপেক্ষমাণ বা অনিষ্পন্ন আবেদন রয়েছে ৩৫১টি। বাকিগুলোর মধ্যে এক হাজার ১৫৯টি প্রতিষ্ঠানকে ডিবিআইডি দেওয়া হয়েছে। ছয় হাজার ৯৬৩টি আবেদনই বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ আবেদনের মাত্র ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন পেয়েছে। আর অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা হিসাবে নিলে নিবন্ধন আবেদন বাতিলের হার ৮৩ শতাংশের বেশি। গত ২৬ মার্চ পর্যন্ত ই-ক্যাব থেকে ডিবিআইডি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ৩০২টি সদস্য প্রতিষ্ঠান। অথচ সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা দুই হাজার ৬৩৫টি। অর্থাৎ মাত্র ১১ শতাংশের কিছু বেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। আবার আবেদনকৃত ৩০২টি ই-ক্যাব সদস্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গৃহীত হয়েছে মাত্র ৬৬টির এবং বাতিল হয়েছে ২২৬টি আবেদন। আবেদন অনিষ্পন্ন আছে ১০টি প্রতিষ্ঠানের। অর্থাৎ ডিবিআইডি প্রদানের হার প্রায় ২২ শতাংশ এবং বাতিলের হার প্রায় ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময় পর্যন্ত এজেন্সি টু ইনোভেট বা এটুআইর আওতাধীন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম একশপের মাধ্যমে ডিবিআইডির জন্য আবেদন জমা পড়েছে ৪৯৩টি, গৃহীত হয়েছে মাত্র ১১টি। আবেদন অপেক্ষমাণ আছে একটি প্রতিষ্ঠানের। বাকি ৪৮১টি আবেদনই বাতিল হয়েছে।
ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিবিআইডি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসচেতনতা এবং ভুল আবেদনের কারণেই বেশিরভাগ বাতিল হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই আবেদনে কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংগঠনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। এ বিষয়ে কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে কথা বলবেন—তারা জানেন না।
ই-লজিস্টিক্স প্রতিষ্ঠান ই-কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের পরিচালক বিপ্লব ঘোষ রাহুল বলেন, উদ্যোক্তা এবং আরজেএসসির মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। আবার এত আবেদন জমা পড়ে, যা আরজেএসসির সীমিত লোকবলে সামলানো কঠিন। তার সঙ্গে যদি আবার ব্যবসায়ীদের ওরিয়েন্টেশন দিতে হয়, তাহলে বিষয়টি আরও জটিল। এজন্য বেসিসের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে খসড়া প্রস্তাবনা দিয়েছি, যেখানে বেসিস ডিবিআইডি আবেদনের প্রথম ‘কন্ট্রাক্ট পয়েন্ট’ হবে। এতে আরজেএসসির কাজ সহজ হবে। পাশাপাশি আবেদনে কোনো ভুল থাকলে সংশোধন করতে পারব। এজন্য বেসিসে ‘ডিবিআইডি ডেস্ক’ চালুর প্রস্তাবনা রয়েছে ওই খসড়ায়।
ডিবিআইডি না থাকলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে নির্দেশিকায় কোনো কিছুর উল্লেখ না থাকা এবং এ-সংক্রান্ত কোনো আইন না থাকায় ব্যবসায়ীরা ডিবিআইডি নিয়ে সচেতন ও আগ্রহী নয় বলে মনে করছে ই-ক্যাব। ইক্যাবের ফাইন্যান্স সেক্রেটারি আসিফ আহনাফ বলেন, ডিবিআইডি সরকারের একটি সময়সাপেক্ষ এবং দূরদর্শী উদ্যোগ। ই-ক্যাব সদস্যদের ডিবিআইডি নিবন্ধনে নিয়মিত তাগিদ দিয়ে থাকি। প্রতিনিয়তই সদস্যদের এ বিষয়ে আহ্বান জানানো হয় এবং তারা সাহায্য চাইলে করা হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ডিবিআইডি এখনো তার প্রত্যাশিত কার্যক্ষমতা পায়নি। ডিবিআইডি না থাকলে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ফলে ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে উদাসীন। আবার যারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন তারা আবেদন করেও সহজে ডিবিআইডি পাচ্ছেন না। অথচ প্রত্যাশা ছিল, এটা ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার থেকেও সহজ হবে। শুরুতে বলা হয়েছিল, একটি সক্রিয় ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ থাকলেই জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই ডিবিআইডি পাওয়া যাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ডিবিআইডি পাওয়াও এত জটিল প্রক্রিয়া হচ্ছে যে, ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
তবে নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। নিবন্ধন পাওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণে বেশকিছু গরমিল ও অসামঞ্জস্যতা পাওয়া যায়। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, daraz.com.bd ওয়েবসাইটের ঠিকানায় ‘ফারহানাস ইউনিক কালেকশন’ এবং ‘দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান ডিবিআইডি পেয়েছে। ডিবিআইডি ওয়েবসাইটে এদের ক্রমিক নম্বর যথাক্রমে ৭৩৯ এবং ৭৪৪। ফারহানাস কালেকশন ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোনো ফেসবুক লিঙ্কের তথ্যও উল্লেখ করেনি। তবে বিষয়টি দারাজ বাংলাদেশ অবগত আছে এবং তাদের পক্ষ থেকে আবেদন পেলে সংশোধন করা হবে বলে আরজেএসসির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে facebook.com-কে নিজের ওয়েবসাইট দেখিয়ে ডিবিআইডি নিয়েছে ‘সাদিয়া ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার অসম্পূর্ণ ঠিকানা দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির ডিবিআইডি ক্রমিক নম্বর ৯১। অথচ নির্দেশিকার ৪.২.৪ (ক) অনুযায়ী, ডিবিআইডি পেতে হলে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় ওয়েবসাইট অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় পেজ থাকতে হবে। ডিবিআইডি আবেদনের শুরু থেকেই যদি শৃঙ্খলা না থাকে তাহলে পরবর্তীতে এ ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন উদ্যোক্তারা।
ই-ক্যাবের আসিফ আহনাফ বলেন, যারা আইডি পাচ্ছেন সেখানে বেশকিছু গরমিল দেখা যাচ্ছে। আবেদনের যাচাই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জন্য ই-কমার্স বিষয়টি নতুন হতে পারে। এজন্য অনেক বিষয়ে তাদের সম্যক ধারণা নাও থাকতে পারে। ই-ক্যাব প্রয়োজনে তাদের জন্য প্রশিক্ষণ বা ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করতে পারে। আবার ই-ক্যাব সদস্য যারা আবেদন করবেন, তাদের সরাসরিও ডিবিআইডি দেওয়া যেতে পারে; কারণ ই-ক্যাব সদস্য পদ দেওয়ার আগে অনেক কিছু যাচাই করে নেয়।
তবে বিষয়গুলোকে কারিগরি ত্রুটি উল্লেখ করে আরজেএসসির প্রোগ্রামার জিকরা আমিন কালবেলাকে বলেন, ২০২১ সালে প্রথমে বিষয়টি ছিল ‘ইউনিক বিজনেস আইডি’। তখন এর উদ্দেশ্য ছিল অনলাইনে যারা ডিজিটাল বাণিজ্য করছেন তাদের তালিকা করা। নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়টি আসে ২০২২ সালে ডিবিআইডি নিবন্ধন নির্দেশিকা আসার পরে। এর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, যারাই এসেছে তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। কিছু পরীক্ষামূলক আইডি দেওয়া হয়েছিল। তাই অনেক সময়েই তথ্য যাচাই করা যায়নি। আবার তখন এটি করত এটুআই। এটুআইর থেকে আরজেএসসির কাছে উপাত্ত স্থানান্তরের সময় সাদিয়া ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মতো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের ডাটা হারিয়ে যায়। তখন ফেসবুক ডটকমের মতো ভুল থেকে যায়। কারিগরি এসব দিক দেখভাল করে এটুআই। আরজেএসসি চাইলেও সংশোধন করতে পারে না। এসব বিষয় সমাধানে গত জানুয়ারিতে এটুআইতে ই-মেইল দেওয়া হয়। বেশকিছু তারা সমাধান করেছে, কিছু বাকি।
অন্যদিকে, ডিবিআইডি সংক্রান্ত বেশকিছু নির্দেশনা পালন করতে দেখা যায় না ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর। যেমন ৪.৩.১ নির্দেশিকা অনুযায়ী ডিবিআইডিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিজের ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বাধ্যতামূলকভাবে ডিবিআইডি প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু ডিবিআইডিপ্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে এই নির্দেশিকা প্রতিপালিত হতে দেখা যায় না। বিষয়টি এখনো শুধু নির্দেশিকা বরং কোনো আইন না হওয়ার কারণে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে আরজেএসসি। আর এর তদারকির দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের উল্লেখ করে আরজেএসসির প্রোগ্রামার জিকরা আমিন বলেন, নির্দেশিকা পালিত না হলে কী হবে, কী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে পরিপূর্ণ আইন হলে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলী কালবেলাকে বলেন, ডিবিআইডিকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করতে পারছি না। কারণ প্রথমত, ডিবিআইডির প্রকৃত কর্তৃপক্ষ কে হবে, তার অর্গানোগ্রাম কী হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়। আরজেএসসি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এটি করছে। দ্বিতীয়ত, নির্দেশিকার কোনো বিষয়ের ব্যত্যয় হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কোনো সুযোগ নেই; কারণ নির্দেশিকায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। দণ্ড আরোপ করা যায় আইন বা আইনের অধীন বিধিমালার মাধ্যমে। তৃতীয়ত, ডিবিআইডি ব্যবস্থায় এখনো কোনো রেভিনিউ আয়ের সুযোগ নেই সরকারের। এটার নিবন্ধন ও তদারকি থেকে যাবতীয় কাজে, পরিমাণ যাই হোক, সেই ব্যবস্থাকে রেভিনিউ সিস্টেমে আনতে হবে। এ বিষয়ে আইন দ্রুতই করা হচ্ছে। তার আগ পর্যন্ত ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ চলছে।