দেশের রপ্তানি আয়ের হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন আর্থিক পরিসংখ্যান ওলটপালট হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই রপ্তানির অঙ্ক কমে যাওয়ায় সরকারের চলতি ও আর্থিক হিসাব পুরোপুরি উলটে গেছে। গত বৃহস্পতিবার সরকারকে দেওয়া এক চিঠিতে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের জন্য হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তন করায় রপ্তানি আয়ের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যের মধ্যে বড় ফারাক দেখা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তথ্যের এই সমন্বয়হীনতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা করে আসছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। এর পরও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ সে তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সব ধরনের নীতি প্রণয়ন করেছে সরকার। এতে একদিকে সরকারি তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতির নাজুক সময়ে নীতিনির্ধারকরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেগুলোর কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানি আয়ের হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তনের পর অর্থনীতিতে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার জন্য অন্যান্য সূচকেরও সঠিক তথ্য নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘রপ্তানি নিয়ে এনবিআর ইপিবি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে কোনো মিল নেই। একেক প্রতিষ্ঠান একেক রকম তথ্য দেয়। এটা দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বলে আসছি। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং গবেষকরা সমস্যায় পড়েন, কারণ তারা কোন তথ্য নেবেন, সেটা নিয়ে ধন্দে পড়েন। শুধু তাই নয়, এর ফলে নীতি নির্ধারণেও সমস্যা হয়। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে সঠিক তথ্য প্রকাশ করা উচিত।’
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সরকারের লেনদেন ভারসাম্যের সামগ্রিক তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় রকম পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। আগের মাসে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ প্রতিবেদনে ওই ৯ মাসের হিসাবে বড় রকম ঘাটতি দেখানো হয়েছে। একইভাবে আগের পরিসংখ্যানে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থাকলেও সর্বশেষ প্রতিবেদনে তা উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সরকারকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নতুন হিসাব পদ্ধতিতে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন আর্থিক পরিসংখ্যান ওলটপালট হয়ে পড়েছে। রপ্তানি কমে যাওয়ায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে পড়েছে। আর রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার লক্ষ্য কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে ফিরে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল থেকে দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়কে রপ্তানি হিসেবে এবং এসব পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানির সময় হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত পণ্য রপ্তানির সময় রপ্তানির প্রাথমিক ঋণপত্র মূল্য থেকে কিছুটা কম হয়ে থাকে, যা ইপিবি সমন্বয় করে না। এ ছাড়া স্টকলট, ডিসকাউন্ট এবং কমিশনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ইপিবি কর্তৃক সমন্বয় করা হয় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব ব্যাংক, ইপিবি, এনবিআরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি ব্যয়, রপ্তানি আয়, অদৃশ্য ব্যয়, অদৃশ্য আয়, রেমিট্যান্সের তথ্য মাসিক ভিত্তিতে সংগ্রহ করে লেনদেন ভারসাম্যের বিবরণী প্রস্তুত করে থাকে। সাম্প্রতিককালে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসা কমে যাওয়ায় ট্রেড ক্রেডিট উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মূলত রপ্তানি (শিপমেন্ট) ও প্রকৃত রপ্তানি আয়ের ব্যবধানের কারণে হয়ে থাকে।
জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যের সমন্বয়হীনতা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত বৃহস্পতিবার ইপিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটো। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে একক কোনো সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ইপিবি আর রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করবে না। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করা হবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ইপিবি রপ্তানির ভুল তথ্য প্রকাশ করে আসছিল। আর ইপিবির এই তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের হিসাব করে এসেছে। এখন রপ্তানির তথ্যে গরমিল ধরা পড়ায় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি, মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিএনপি, লেনদেনের ভারসাম্য, বিদেশি ঋণ গ্রহণের নীতি সিদ্ধান্তসহ অর্থনীতির অনেক কার্যক্রমের সূচক সংশোধনেরও দাবি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
একই বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এটা কেবল রপ্তানির ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর তথ্যে মিল নেই। এর মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা এবং দক্ষতার অভাব স্পষ্ট হয়। ফলে নীতিনির্ধারকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। আর ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্তও ভুল হয়।’
তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে যাব। এত দিন রপ্তানির তথ্যে আমাদের যে সক্ষমতার কথা বলা হচ্ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে সেই সক্ষমতা কম। ফলে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাত বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। আমাদের শতকরা ৪০ ভাগ শিল্প হচ্ছে রপ্তানিমুখী। ফলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও এর সঠিক প্রভাব পাওয়া যাবে না।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আইএমএফের চাপে দেরিতে হলেও সংস্থাগুলো সঠিক তথ্য প্রকাশ করা শুরু করেছে। এটা ভালো দিক। ফলে রপ্তানির হিসাব যত বড় করে দেখানো হতো, আসলে রপ্তানি এত বেশি নয়। রপ্তানির হিসাব বেশি দেখানোর কারণেই চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত আসত।’
অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি রপ্তানিকারকরাও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এটি নিছক কোনো ভুল নয়, এটা একটা ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্র করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশি রপ্তানি বেশি দেখিয়ে এই খাতের রপ্তানি সহায়তা কমানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের দায়িত্বে থাকা নেতৃত্ব জেনে বুঝে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খুশি করতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। ভুল জেনেও রাজনৈতিক নেতৃত্বে এসব পরিসংখ্যান ব্যবহার করেছে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘রপ্তানির ক্ষেত্রে এত দিন ধরে ভুল তথ্য দেখিয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে নগদ সহায়তা কমানো হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের শিল্প খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।’
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, ‘ইপিবি রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করে, তার সঙ্গে আমাদের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি তথ্যের মিল নেই। এ নিয়ে দুই বছর আগে রপ্তানি-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটিতে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। তখন ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অন্যরা আমাদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আমরা আপনাদের রপ্তানি বেশি দেখানোর চেষ্টা করছি, আর আপনারা (ব্যবসায়ীরা) বলেন কম। এভাবে ভুল তথ্য দেখিয়ে তাদের রপ্তানি প্রণোদনা কমানো হয়েছে।’