প্রজাপতি মানেই বাহারি রঙের ছটা। যে রং মানুষের মনে নান্দনিকতার সুরের জন্ম দেয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতি সংরক্ষণ অতি জরুরি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, নগর উন্নয়নসহ নানা কারণে আজ অস্তিত্ব সংকটে প্রজাপতি। বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রজাপতি বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। মনোহর প্রজাপতি রক্ষায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিজ্ঞানীরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সচেতন না হলে অচিরেই প্রজাপতি হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন মূলত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শেষ আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু উপকূলীয় এই ম্যানগ্রোভ পরিচিত ৩৭ প্রজাতির প্রজাপতিসহ অন্যান্য ছোট প্রাণীরও আবাসস্থল হিসেবে। গাছপালা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে ক্ষুদ্র প্রাণী প্রজাপতি। বিভিন্ন উদ্ভিদের মধ্যে পরাগায়ন ঘটিয়ে নতুন নতুন উদ্ভিদের জন্ম দেয়। বনের পুরো বাস্তুসংস্থানের প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে সহায়তা করে প্রজাপতি। কিন্তু সুন্দরবন এবং দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই প্রজাপতি আজ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। কিছু বিশেষজ্ঞ প্রাণী বিলুপ্তির এই প্রক্রিয়ার একটি ডাকনাম দিয়েছেন। সেটা হলো দ্য ইনসেক্টস অ্যাপোকিলপস’ বা কীটপতঙ্গের সর্বনাশ।
কিছু অনুমান অনুসারে, গত দেড়শ বছরে আড়াই থেকে পাঁচ লাখ কীটপতঙ্গের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বর্তমানে আরও বহু প্রজাতি তাদের টিকে থাকার লড়াইয়ের শেষপ্রান্তে পৌঁছেছে।
এসব প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং নগর উন্নয়ন। সেইসঙ্গে প্রজাপতি বা অন্যান্য কীটপতঙ্গের জন্য আইনি সুরক্ষা এবং বড় আকারের কোনো উদ্যোগ না থাকা।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যদি আমাদের সরকার সচেতন না হয়, তাহলে প্রজাপতি হারিয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে দ্রুত ঘটছে, তাতে সম্ভবত আগামী ১০ বছরের মধ্যেই এটা ঘটবে।
অধ্যাপক মনোয়ার জানান, আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে বাংলাদেশে প্রজাপতির অনন্য সৌন্দর্য ও প্রাণবন্ততা তার মনোযোগ কাড়ে। তিনি তার কর্মজীবনে রেকর্ড ভাঙা তাপপ্রবাহ, বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াসহ জলবায়ু সংকটের উদ্ভব পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি তার গবেষণায় বাংলাদেশের চারশর বেশি প্রজাতির প্রজাপতির ওপর এর প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
প্রজাপতিসহ কীটপতঙ্গ সাধারণত শীতল রক্তের হয়ে থাকে। যে কারণে তারা অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মতো তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সহজেই অভিযোজন করতে পারে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহ তাদের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। অনেক কীটপতঙ্গ আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ধরন বা ঝড় থেকে বাঁচতে দূরে কোথাও নিজেদের স্থানান্তর করতেও সক্ষম নয়।
ঝুঁকি সত্ত্বেও বাংলাদেশে বর্তমানে প্রজাপতির কম সুরক্ষা আছে। যেমন—প্রজাপতিদের জন্য সুরক্ষিত এলাকা অথবা নমুনা সংগ্রহ বা ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞা। কোনো ধরনেরই সুরক্ষাই নেই। অধ্যাপক মনোয়ার এই ঘাটতি বিষয়টি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক আকর্ষণ করেছেন। সেইসঙ্গে তিনি বাঘের মতো অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য তহবিলের বিষয়টিও তুলনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার নিজস্ব অধিকার রয়েছে। সুতরাং আমি প্রজাপতির সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। কিন্তু আমার দেশের প্রেক্ষাপটে বাঘের জন্য লাখ লাখ ডলার আছে।’ অধ্যাপক মনোয়ার বলেন, ‘অনেক সময় আমরা সরকারকে বলি, কেন প্রজাপতি অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না?’
অধ্যাপক মনোয়ার তার গবেষণায় কমিউনিটি এডুকেশন এবং নাগরিক বিজ্ঞানকেও একীভূত করেছেন। তার উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে প্রতিযোগিতা এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমসহ বার্ষিক প্রজাপতি মেলা হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ২০১৫ সালে খোলা হয়েছে প্রজাপতি পার্ক ও গবেষণা কেন্দ্র। এটি শুধু গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রজাপতির প্রজননই করে না, এটি ক্যাম্পাসে একটি পাবলিক গার্ডেন হিসেবেও কাজ করে।
২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশি প্রজাপতির জন্য সুরক্ষিত এলাকা দুই শতাংশেরও কম।
এদিকে, বাংলাদেশের মতো নিজের শহর ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতেও প্রজাপতির অস্তিত্ব সংকটের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন নিতিন রবিকণ্ঠচারী। তিনি বলেন, ভারতে প্রজাপতি নিয়ে অধ্যয়ন করা লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। রবিকণ্ঠচারীর শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় ক্যামেরা হাতে ব্যাঙ্গালুরুর পার্ক ও বাগানে কাটিয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিজ্ঞানে ডিগ্রি শুরু করার পরেও। তিনি শহরে ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে হাঁটতেন এবং প্রজাপতির ছবি তুলতেন। এভাবেই প্রজাপতি নিয়ে তার আগ্রহের জন্ম হয়। তখনই তিনি প্রজাপতির গুরুত্ব তুলে ধরতে ‘কিছু করার’ সিদ্ধান্ত নেন। ২০১২ সালে রবিকণ্ঠচারী এবং আরও তিনজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যাঙ্গালর বাটারফ্লাই ক্লাব (বিবিসি)। এরপর তারা শহরে প্রজাপতির প্রজাতি নিয়ে গবেষণা চালাতে শুরু করেন। তাদের এ উদ্যোগ ব্যাপকভাবে সফল হয়।
তারা ব্যাঙ্গালুরুতে ১৭০ প্রজাতির প্রজাপতির তথ্য তালিকাভুক্ত করেছেন। যার মধ্যে ১৪টি প্রজাতি সম্পর্কে আগে কখনো জানা যায়নি। বৈজ্ঞানিক নথিতে ১২০ বছর ধরে অনুপস্থিত থাকার পর বিলুপ্ত মনে করা হয়েছে—এমন প্রজাতিও পুনরায় আবিষ্কার করেছেন রবিকণ্ঠচারী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার কীটতত্ত্ব গবেষণার সংগ্রহে কিছু আশাব্যঞ্জক সংযোজন দেখা গেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো প্রজাপতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সূত্র: মঙ্গাবে ডটকম