দেশে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা হলেও এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। জনগুরুত্ব মামলা রেখে সরকারের দুর্নীতিবাজদের ‘ক্লিনশিট’ দেওয়ায় ব্যস্ত থাকার অভিযোগ পুরোনো। স্বশাসিত সংস্থা হলেও সরকার নাখোশ হয়—এমন মামলায় তদন্ত করতে এতদিন অনিচ্ছুক ছিল তারা। তবে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই সরব হয়ে উঠেছে দুদক। গত এক সপ্তাহে সরকারের প্রভাবশালী অন্তত ৫০ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মামলাও হয়েছে ডজনের বেশি। তবে দুদকের কর্মকর্তারাই বলছেন, কমিশন নিজেদের দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে অভিযোগপূর্ণ তদন্ত না করে আংশিক প্রতিবেদন দিয়েই মামলা করে দিচ্ছে। এর ফলে অপরাধীদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুদকের তথ্যমতে, সরকারের পতনের পর থেকেই সাবেক মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জোরেশোরে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তাদের অনুসন্ধানের তালিকায় রয়েছেন প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান। মাদারীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক চিফ হুইফ নূরে আলম চৌধুরী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক ত্রাণ ও দুযোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী
গোলাম দস্তগীর গাজী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, সাবেক পররাষ্ট্বমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান।
তালিকায় আরও রয়েছেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও জয়পুরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিনসহ অন্তত এক ডজন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি। গত ১৫ বছরে এসব মন্ত্রী-এমপির আয় বেড়েছে গড়ে কয়েক হাজার গুণ। কারও ক্ষেত্রে সম্পদ ও আয় বেড়েছে লাখ গুণ পর্যন্ত।
এ ছাড়া তদন্ত শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপপ্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খানসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, এসব কর্মকর্তার মধ্যে সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামালের বিরুদ্ধে এর আগেও দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছিল। ২০২০ সালে শাহ কামালকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ায় ২০১৪ সালে তাকে দুদকে তলব করা হয়েছিল। এ ছাড়া ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধেও এর আগে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছিল। তবে সে সময় প্রভাবশালী এই কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় যে সম্পদের বিবরণ পেশ করেছিলেন, সেখানে আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদ বেড়েছে, এমন অন্তত দেড়শ
এমপি-মন্ত্রীর নাম আলোচনায় আসে। তবে নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের ‘ইমেজের’ কথা চিন্তা করে বিষয়টি সামনে আনতে চাননি দুদক চেয়ারম্যান। নির্বাচনের পরও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো একাধিক প্রভাবশালী এমপি দুর্নীতি করেননি জানিয়ে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে দুদকের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘এই কমিশন দুর্নীতি প্রতিরোধে পুরোপুরি ব্যর্থ। এখন তারা দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে পুরোনো অভিযোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে কমিশনে জমা পড়েছিল। এতদিন তারা এসব অভিযোগ নিয়ে কাজ করেনি। ফলে দুর্নীতিবাজরা ধীরে ধীরে হয়েছে আরও লাগামহীন।’
দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একজন প্রভাবশালী নেতা কালবেলাকে বলেন, ‘দুদকের কাজ তপশিলভুক্ত অভিযোগ নিয়ে জনগুরুত্ব বিবেচনায় কাজ করা। কিন্তু তারা সেটি না করে সরকারের আদেশ-নির্দেশনামতো কাজ করেছে। এখন তারা নিজেদের চেয়ার বাঁচাতে তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন পুরোনো ফাইল খুলছে। এর মাধ্যমে কমিশন মূলত নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ করতে চাচ্ছে।’
এই নেতা আরও বলেন, ‘কমিশন এখনো ফাইল চালু করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা কোথাও অভিযান চালাচ্ছে না, কোথাও যাচ্ছে না। মাঠ কর্মকর্তাদের তদন্তের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিচ্ছে না। এ ছাড়া তাড়াহুড়ো করে কাজ করায় অনেক মামলা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হচ্ছে না, সময় দেওয়া হচ্ছে না। কিছু একটা পেলেই মামলা করে দিচ্ছে। ফলে এসব মামলায় আসামিদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন যে কার্যক্রমগুলো করছে, আপনারা দেখে থাকবেন। এক বছর থেকেই তো অনেক গতি এসেছে। এটা আপনাদের স্বীকার করতেই হবে। আমাদের কাছে অভিযোগ এলে সেগুলো অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুদক। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো আমরা মনে করব, দুদক সরব হলো। আমরা প্রত্যাশা করব, যারা এতদিন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।’
তিনি বলেন, ‘দুদক জন্মলগ্ন থেকেই সরকার ও ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, সেটি মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত। এখন দুদক যতই সরব হোক না কেন, তারা কোনোভাবেই নিজেদের দায় এড়াতে পারে না। এখন ছাত্ররা যেভাবে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার কথা বলছেন, সেখানে দুদককে ঢেলে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই।’