চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয় অবরুদ্ধ করে রাখা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহিংসতায় জড়িত আনসার সদস্যদের চিহ্নিতের কাজ শুরু হয়েছে। অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের ‘রেস্ট টাইম’ বাতিল, আত্তীকরণসহ অন্যান্য যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও একটি গ্রুপ আন্দোলন চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। তাদের উসকানিতেই সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি ও ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এই উসকানিদাতাদের চিহ্নিতে কাজ শুরু করেছে আনসার সদর দপ্তর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলায় সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তারা আর আনসারে থাকতে পারবেন না। যারা সম্পৃক্ত নন, তারা যেন বিনা কারণে চাকরিচ্যুত না হন, সে ব্যাপারেও সদর দপ্তর কাজ করছে।
কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, অতীতে যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গজনিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে চাকরি হারিয়েছেন, তারাই মূলত উসকানি দিয়েছেন। এর বাইরে বহিরাগত একটি অংশ অতিরিক্ত পোশাক ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলেন। যেগুলো পরে তারা সহিংসতায় অংশ নেন।
বিশৃঙ্খলায় জড়িতদের শনাক্তে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, ছবি, ভিডিও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আনসার সদর দপ্তর। গতকাল বুধবার আনসার মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ জড়িতদের চিহ্নিতে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি কালবেলাকে জানিয়েছেন, এই কমিটি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে জড়িতদের শনাক্ত করে প্রতিবেদন দেবে। পরবর্তী সময়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২৫ আগস্ট সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চাকরি জাতীয়করণসহ কয়েকটি দাবিতে অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা সচিবালয় ঘেরাও করে রাখেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানান। অফিস ছুটির পরও আনসার সদস্যদের অবরোধের কারণে সচিবালয় থেকে সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বের হতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে সচিবালয়ের ভেতরেও ঢুকে পড়েন তারা। আনসার সদস্যদের এই অবস্থানের কারণে গত রোববার দিনভর রাজধানীতে ছিল ব্যাপক যানজট।
সচিবালয়ে আনসার সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহসহ অনেককে আটকে রেখেছেন—রাতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। আনসার সদস্যদের প্রতিহত করতে তারা মিছিল নিয়ে সচিবালয় এলাকায় যান। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে হাসনাত আবদুল্লাহসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এক সাংবাদিকসহ কয়েকজন আনসার সদস্যও আহত হন।
সংঘর্ষের পর ৩৭৭ আনসার সদস্যকে আটক করা হয়। তারাসহ অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের ৪ থানায় মামলা হয়েছে। এতে অভিযোগ আনা হয়, ৮ থেকে ১০ হাজার আনসার সদস্য অনুমতি না নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। একই সঙ্গে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কথা অমান্য করে কর্মসূচি প্রত্যাহার না করে সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করেন। সচিবালয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকারি কাজে বাধা দেন। একই সঙ্গে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে সচিবালয়ে গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আনসার সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বেশ কিছু দাবিতে আনসার সদস্যদের আন্দোলনের মুখে গত রোববার আত্মীয়করণ, রেস্ট টাইম বাতিলসহ বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্তের পর আনসারদের একাংশ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু অন্য অংশ আন্দোলন চালিয়ে যায়। তারা দাবি তুলে আত্মীয়করণ নয়, জাতীয়করণ করতে হবে। এবং তা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে বিশৃঙ্খলা এড়াতে রোববার বিকেল ৫টার মধ্যে আনসার সদস্যদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত করার নির্দেশনা দেয় সদর দপ্তর।
আনসার সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিকেল ৫টার মধ্যে যারা কর্মস্থলে যোগ দিয়েছিলেন তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হবে না। রাত ১০টার মধ্যে যারা কর্মস্থলে যোগদান করেছিলেন এবং যারা সহিংসতা-সংঘর্ষে জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সদর দপ্তর নির্দেশিত সময়ের মধ্যে যারা কর্মস্থলে যোগ দেননি তারাও শাস্তির আওতায় আসবেন। মামলায় গ্রেপ্তারদের পাশাপাশি একটি সংখ্যক আনসার সদস্য এখনো পলাতক রয়েছেন। যারা পরবর্তী সময়ে কর্মস্থলে যোগ দেননি। তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের মধ্যে গত রোববার পর্যন্ত ৫৫ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৫ হাজার সদস্য বিশ্রামে ছিলেন। এখন যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন বা যারা আন্দোলনের নামে নাশকতা করেছেন তাদের বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের স্থলে বিশ্রামে থাকা সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা মূলত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘বৈধ ভাড়াটে কর্মী’ হিসেবে নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বে আনসার সদস্য প্রয়োজন হলে বাহিনীতে আবেদন করলে তাদের সেই দায়িত্বে পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রে বাহিনীর অনুকূলে চুক্তি অনুযায়ী এই দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অর্থ পরিশোধ করে থাকে। তবে এই সদস্যদের বেতন হয় বাহিনী থেকে। বাকিরা বেতন-ভাতা পান না।