যে কোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এরই মধ্যে সিইসি এবং অন্য কমিশনাররা পদত্যাগের সার্বিক প্রস্তুতি সেরে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তাদের ঘনিষ্ঠরা।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো নির্বাচন কমিশনেও সংস্কার আসছে এটি নিশ্চিত বলে মনে করছে বর্তমান কমিশন। সেজন্য বেশ কয়েকদিন ধরেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা অফিস করলেও বর্তমানে তাদের বিদায়ের প্রস্তুতিই প্রাধান্য পাচ্ছে। শেষ সময়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জরুরি কাগজপত্রসহ অন্যান্য সামগ্রী সরিয়ে নিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে গতকাল সোমবার কমিশন বৈঠক করার পর কমিশনে তাদের পদত্যাগের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। আজকালের মধ্যেই সিইসিসহ সব
কমিশনার পদত্যাগ করতে পারেন বলেও চাউর ওঠে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গতকাল সন্ধ্যায় কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা যে কোনো সময় পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত। তবে সময় কখন সেটা বলতে পারছি না।’
তবে আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) পদত্যাগ করছেন কি না, জানতে চাইলে আরেক কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন ‘না’ সূচক উত্তর দিয়ে কল কেটে দেন।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথের পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক রদবদল চলছে। পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে সব সেক্টরেই। রাষ্ট্র সংস্কারের চলমান প্রেক্ষাপটে কেউ স্বেচ্ছায়, আবার কেউ বাধ্য হয়ে পদত্যাগপত্রে সই করছেন। এ থেকে বাদ যায়নি বিচারাঙ্গনসহ বড় বড় স্বায়ত্তশাসিত এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের বিষয়টিও বেশ জোরেশোরে আলোচনা চলছিল গত কয়েকদিন। এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি পত্রিকায় একটি কলাম লিখে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। কলামে তিনি ‘অসাংবিধানিক উপায়ে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে’ বলে সমালোচনা করেন। পাশাপাশি হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয়া বর্তমান সরকারের কোনো কোনো কর্মকাণ্ডেরও সমালোচনা করেন সিইসি।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজেদের অবস্থান ও করণীয় জানতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে দেখা করার বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে আউয়াল কমিশন। আর সরকারের সাড়া না পেয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল কলাম লিখে সরকার বা জনগণকে তাদের নিজেদের অবস্থান জানানোর চেষ্টা করেছেন। সেখানে তিনি নিজেও দাবি করেন, আলোচনার জন্য কোনো লোক না পাওয়ায় তিনি পত্রিকায় কলামের মাধ্যমে বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এ কলাম নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে থেকে সংসদ ভাঙা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করায় সিইসি পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া সিইসি পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন বলে মনে করছিলেন অনেকে। তবে আউয়াল কমিশন যে সরে দাঁড়াতে যাচ্ছে, এই কলাম তার পূর্ব প্রস্তুতি বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর দিন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল, কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব, মো. আলমগীর, বেগম রাশিদা সুলতানা দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন। এ দিন কমিশনার আনিসুর রহমান কর্মস্থলে উপস্থিত হননি। এরপর থেকে সিইসিসহ অন্যরা অনিয়মিতভাবে যে যার সুবিধামতো সময় অফিস করে চলেছেন। তবে, মাঝে ১২ আগস্ট তারা জরুরি বৈঠকে বসেন। জানা গেছে, ওই বৈঠকে তারা পদত্যাগের বিষয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকে পদত্যাগের বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করারও সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব-পরিচয়ের সূত্র ধরে সিইসি নিজেই ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। তবে, বিভিন্ন মারফতে চেষ্টা হলেও সাক্ষাতের জন্য প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের কোনো সাড়া মেলেনি বলে নির্বাচন কমিশন ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, কমিশনারদের মধ্যে বর্তমানে আহসান হাবীব মোটামুটি নিয়মিত অফিস করছেন। অন্যরা মাঝে মধ্যে দপ্তরে আসেন। কমিশনার আনিছুর রহমান খুবই কম আসেন। তবে গতকাল সিইসিসহ বাকি সব কমিশনারই অফিস করেছেন। সেখানে বিদায়ের আগে গণঅধিকার পরিষদ ও নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। এর আগে আদালতের আদেশে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) কে নিবন্ধন দেওয়া হয়।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন। সাংবিধানিকভাবে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন তারা। অন্য কমিশনাররা হলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব আনিছুর রহমান। শুরুতে দায়িত্ব গ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ আয়োজন করে কমিশন; কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকারবিরোধী জোট এই কমিশনকে শেখ হাসিনা সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের সেই সংলাপ প্রত্যাখ্যান করে। পরে সময়ে বিরোধী দলগুলো নিয়ে নানা ধরনের কটূক্তিমূলক বক্তব্য দেন কমিশনাররা। বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতা ও বর্জন সত্ত্বেও এই কমিশনের অধীনে এই বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এতে আগের কমিশনের মতো এই কমিশনকেও আওয়ামী লীগ সরকারের চূড়ান্ত সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান (১১৮ অনুচ্ছেদ) অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজন নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতির আদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত। আর রাষ্ট্রের যে কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় অথবা রাষ্ট্রপতির আদেশে পদত্যাগ করবেন। নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ এসব পদে কার্যকালের মেয়াদ তাদের কার্যভার গ্রহণের দিন থেকে পাঁচ বছর।