শরীফ বিশ্বাস, কুষ্টিয়া
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৭ এএম
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বেপরোয়া মাইক্রো কেড়ে নিল চার স্কুলছাত্রীর প্রাণ

বেপরোয়া মাইক্রো কেড়ে নিল চার স্কুলছাত্রীর প্রাণ

রোববার। ঘড়ির কাঁটা সকাল পৌনে ৭টার ঘরে। পূর্বদিকের সূর্য সবে আলো দিতে শুরু করেছে। কাকডাকা ভোরে ১৩ শিক্ষার্থী কুষ্টিয়ার খোকসার শিমুলিয়া কুঠিপাড়া জামে মসজিদের মক্তব থেকে কোরআন পড়ে বাড়ি ফিরছিল। অন্যরা ভিন্ন পথে নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা করলেও শিমুলিয়ার পূর্বপাড়া এলাকার শিশুছাত্রী তানজিলা তার বোন মারিয়া, যূঁথী, মিম ও ফাতেমা সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে ব্যস্ত। বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে আবার যেতে হবে স্কুলে। কিন্তু তাদের সেই তাড়া নিমেষেই থমকে দেয় সবকিছু। রাজবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা বেপরোয়া মাইক্রোবাস পথে তাদের পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সবাইকে নিয়ে পড়ে যায় সড়কের পাশে পুকুরে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় মিম খাতুন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় অন্যদের প্রথমে নেওয়া হয় খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরে নেওয়া হয় কুষ্টিয়ার আড়াইশ শয্যার হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে মারা যায় তানজিলা, মারিয়া ও যূঁথী।

ফাতেমাকে গুরুতর অবস্থায় পাঠানো হয় ঢাকায়।

নিহত চার শিশু হলো কুঠিপাড়া এলাকার পালন শেখের মেয়ে তানজিলা আক্তার (১৪) ও মারিয়া খাতুন (১১), হানিফ শেখের মেয়ে মিম খাতুন (১২) ও হেলালের মেয়ে যূঁথী খাতুন (৯)। আহত ফাতেমা খাতুন (৯) আনারুল ইসলামের মেয়ে।

গতকাল শিমুলিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে চার স্কুলছাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে সেখানে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। তানজিলা ও মারিয়া দুই বোন শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। আর মিম পূর্বাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। মিম ও যূঁথীর বাড়ি শিমুলিয়া গ্রামেই। সড়ক দুর্ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। পরে পুলিশের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

নিহত তানজিলা ও মারিয়ার বাবা পলান মিয়া জানান, তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তানজিলা ও মারিয়া ছিল অত্যন্ত মেধাবী। কৃষিকাজ করে তাদের পড়ালেখার খরচ জোগাতেন তিনি। এক মেয়েকে ডাক্তার ও অন্যজনকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু সে স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল।

মক্তবে তানজিলা ও মারিয়ার সহপাঠী ছিল খাদিজা খাতুন। চমৎকার সখ্য ছিল তিনজনের। কিন্তু প্রিয় বান্ধবীদের এমন অকালমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না খাদিজা।

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত মিম। বাবা আবু হানিফ কৃষিকাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। ইচ্ছা ছিল মেয়েকে হাফেজি পড়াবেন। সে কারণে আরবি শিখতে দিয়েছিলেন মক্তবে। তার সেই ইচ্ছায় আজ গুড়ে বালি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিমের চাচা আব্দুর রাজ্জাক জানাচ্ছিলেন এসব কথা।

স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুল হামিদ মণ্ডলের বাড়ি একই এলাকায়। নিহত চার শিক্ষার্থী যখন মক্তবে পড়তে যায়, তখন তিনি ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরেন। হঠাৎ খবর পান দুর্ঘটনার। দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম চালান।

প্রত্যক্ষদর্শী ষাটোর্ধ্ব আয়ুব আলী ঘটনাস্থলের খুব কাছাকাছি ছিলেন। হঠাৎ ভারী একটা আওয়াজ শুনে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। দেখেন পানিতে পড়ে আছে কালো রঙের মাইক্রোবাস। পুকুরের মধ্যে কয়েকজন মেয়ে কাতরাচ্ছে। অনেককে ডেকে নিয়ে তিনিও উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেন।

যে মসজিদের মক্তবে পড়ছিল নিহত চার শিক্ষার্থী, সেই মসজিদের ইমাম আব্দুল হক জানান, সকাল পৌনে ৭টার দিকে ১৩ জন আরবি পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। মিনিট তিনেকের মধ্যে হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনতে পান। ছুটে এসে দেখেন তার প্রিয় শিক্ষার্থীরা পুকুরের মধ্যে কাতরাচ্ছে।

ইমাম আব্দুল হক জানান, মারিয়া ও মিম আজই (গতকাল) কোরআন পড়তে শুরু করেছে। এজন্য তারা বাতাসা খাইয়ে মিষ্টিমুখও করিয়েছে সবাইকে। এ উপলক্ষে সবার মঙ্গল কামনা করে দোয়া পড়ানো হয়েছে। তানজিলা ও যূঁথীও ১০-১২ দিন আগেই কোরআন পড়া শিখেছে। তারা সবাই অত্যন্ত মেধাবী।

এদিকে ঘটনার পরপরই কুষ্টিয়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি সড়ক সচলে কাজ করেন তারা। কুষ্টিয়া হাইওয়ে পুলিশের অফিসার ইনচার্জ আকুল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, দুর্ঘটনার সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাস পানি থেকে উদ্ধার করা যায়নি। তবে মাইক্রোবাসের চালক পালিয়েছে। নিয়ম না মেনে মাইক্রোবাস চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান হাইওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা।

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিল তানজিলা ও মারিয়া: মেধাবী তানজিলার চেয়ে মারিয়া এক বছরের ছোট হলেও তারা একই ক্লাসে অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। বাবার ইচ্ছা ছিল তানজিলাকে ডাক্তার বানাবেন। আর ছোট মেয়ে মারিয়াকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। বাবা পলান মিয়া কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিলেন। সহপাঠী খাদিজা আর শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুজ্জামানও জানান তাদের ইচ্ছার কথা।

শিমুলিয়া পূর্বপাড়ায় শোকের মাতম: দুর্ঘটনার পর থেকেই শিমুলিয়াজুড়ে সৃষ্টি হয় শোকের মাতম। তানজিলা-মারিয়াদের বাড়ির পাশেই যূঁথী ও মিমের বাড়ি। তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই ভিড় জমিয়েছেন বাড়ির আঙিনায় নিহতদের এক নজর দেখতে। লোকে লোকারণ্য, কোথাও যেন তিল ধারনের ঠাঁই নেই। স্বজনদের কান্নার রোল পড়েছে চারদিকে। একে অন্যকে দিচ্ছেন সান্ত্বনা। সহপাঠী-শিক্ষকদের কান্নাও যেন থামছে না।

মৃত্যুর আগে বাতাসা খাইয়েছে মক্তবের শিক্ষার্থীদের: রোববার সকালে কায়দা আর আমপারা শেষ করে কোরআন শরিফ পড়তে শুরু করেছে মারিয়া ও মিম। প্রথম কোরআন শরিফ পড়লে মক্তবে রেওয়াজ রয়েছে মিষ্টিমুখ করানোর। সেটিই করেছিল মিম খাতুন আর মারিয়া। তাই বাড়ি থেকে বাতাসা নিয়ে গেছে সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে। পড়েছে বিশেষ দোয়া-দরুদও। আবেগঘন কণ্ঠে এমন কথাই জানান কুঠিপাড়া জামে মসজিদের ইমাম আব্দুল হক।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘কৈফিয়ত’ দিলেন ফারুকী

নেট দুনিয়ায় কারা বেশি ছবি শেয়ার করেন, সুখী নাকি অসুখী দম্পতি?

বিএনপি ক্ষমতায় এলে কৃষকদের ফারমার্স কার্ড করে দেওয়া হবে : টুকু

মানবপাচারবিরোধী পদক্ষেপ জোরদার করেছে বাংলাদেশ : মার্কিন রিপোর্ট

নৌকাডুবিতে নিখোঁজ দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার

ঘুমের মধ্যে মুখ থেকে লালা পড়া কীসের লক্ষণ?

ভারত নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিলেন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি

‘বাংলাদেশ-চীনের জনগণের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়েছে’

রাত ১টার মধ্যে ঝড়-বজ্রবৃষ্টি হতে পারে যেসব অঞ্চলে

চাঁদাবাজদের ছাড়িয়ে নিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের ওপর হামলা

১০

৭ অক্টোবর বছরের প্রথম সুপারমুন, বাংলাদেশ থেকে দেখা যাবে কি?

১১

বিপিএল থেকে সরে দাঁড়াতে পারে ফরচুন বরিশাল

১২

ইরানের হামলার ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে চান ইসরায়েলি রাজনীতিক

১৩

ইয়ারফোন কানে না দিলে কাজে মন বসে না? অজান্তেই যে ক্ষতি করছেন

১৪

ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে পাকিস্তানের বার্তা

১৫

অস্ট্রেলিয়া সিরিজের জন্য চমক রেখে ভারতীয় দল ঘোষণা

১৬

যশোরে এক দিনে কাঁচা মরিচ কেজিতে বাড়ল ১৭০ টাকা

১৭

গাজায় হামলা বন্ধে ট্রাম্পের আহ্বানের পরই বোমা ফেলল ইসরায়েল

১৮

সচিবালয়ে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ

১৯

নির্বাচন বিলম্বিত হলে ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হবে: সালাহউদ্দিন

২০
X