ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট দেশের অনেক থানার মতো সাভার মডেল থানায়ও হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ থানায় হামলাকারীদের মধ্যে কয়েকজনের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। একাধিক ভিডিও ও ছবির সূত্রে মিলছে তথ্য। এর মধ্যে দুটি ভিডিও এবং ফেসবুকে থাকা একাধিক ছবি মিলিয়ে দেখা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুবলীগের ব্যানারে মাঠে থাকা কয়েকজন ভোল পাল্টে মিশে যায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে। তারা নিয়ন্ত্রণ নেয় সাভার থানার, ভেতরে বসায় প্রহরা। ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ৩ আগস্ট দুপুরের পর সাভার থানা রোডে মোফাজ্জল-মোমেনা চাকলাদার কলেজের সামনে স্থানীয় যুবলীগ ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে মিছিল বের করে। সেখানে রড ও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র হাতে
কয়েকজনকে উত্তেজিত অবস্থায় দেখা যায়, যার সম্মুখে ছিলেন কালো রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত মাথায় চুল কম এমন এক যুবক। তাকে থানা রোডের পাশে বিভিন্ন অলিগলিতে থাকা ছাত্র-জনতাকে ধাওয়া দিতে দেখা যায়। এক মিনিটের আরেক ভিডিওতে যুবলীগের মিছিলে তাকে উত্তেজিত অবস্থায় দেখা গেছে।
এদিকে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিকেলে ওই যুবকসহ পূর্বে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের মিছিলে সরাসরি অংশ নেওয়া কয়েকজন যুবককে সাভার মডেল থানার ভেতরে দেখা যায়। ৬ আগস্ট ফেসবুকে লাঠি হাতে থানার ভেতরে একদল যুবককে অবস্থানের ভিডিও দেখা যায়। একদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে রড ও অস্ত্র হাতে মিছিলে অংশগ্রহণ, অন্যদিকে দুদিন পর তার ভোল পাল্টে লাঠি হাতে থানায় অবস্থানের চিত্রে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুবলীগের মিছিলের সামনে থাকা ওই যুবকের নাম রাজীব। তার বাবার নাম রেজাউল করিম। বাসা সাভার অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে। তিনি তার ফেসবুক আইডিতে ৬ আগস্ট সকালে থানার ভেতরে অবস্থান নিয়ে তোলা ছবি পোস্ট করে লেখেন ‘দেশ স্বাধীনের পর আমরা’। পরে জানা যায়, ওই যুবক সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ। তিনি সাভার পৌর যুবলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সরকার পতনের পর রাজীব একদল যুবক নিয়ে সাভার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এলাকা ও সাভার অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-জনতার বিজয় উদযাপন করেন! গত ৩ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রাপ্ত ভিডিও এবং তথ্যপ্রমাণ মেলালে রাজীবের যুবলীগ থেকে বৈষম্যবিরোধী হয়ে থানায় ঢুকে যাওয়ার পুরো যোগসূত্র পাওয়া যায়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর সাভার থানা লুট ও অগ্নিসংযোগের সময় একদল যুবককে দেখা যায়। তখন রাজীবও ছিলেন থানা চত্বরে। পরদিন সেই ছবি তিনি নিজেই পোস্ট করেন ফেসবুকে। পুলিশ ও প্রশাসনের চোখে ভালো সাজতে থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে একটি তিনি সাভার সেনানিবাসে গিয়ে জমা দেন ৮ আগস্ট। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, থানার আশপাশের মহল্লার বাসিন্দা এমন কয়েকজন যুবক থানা লুটপাটে সরাসরি জড়িত। তাদের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ চলছে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েক হাজার ব্যক্তির নামে মামলা করেছে পুলিশ। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কেউ আটক হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নবম শ্রেণির ছাত্র সবুজ হোসেনকে ক্রিকেট খেলার ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা মামলার আসামি রাজীব। সবুজ খুনের পর সৌদি আরব পালিয়ে গেলেও দেশে ফিরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। কারাভোগের পর আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্ত হন তিনি। ওই মামলা বর্তমানে বিচারাধীন।
সাভার মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ জুয়েল মিয়া কালবেলাকে বলেন, ভোল পাল্টে জনতার কাতারে মিশে গেলেই কোনো অপরাধী পার পাবে না। প্রকৃতপক্ষেই যদি কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আইনবহির্ভূত কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা তদন্তসাপেক্ষে তাকে আইনের আওতায় আনব। রাজীবের যে ভিডিওটি আমরা হাতে পেয়েছি, সেটি যাচাই-বাছাই করে আমরা দেখছি।