রাশেদ রাব্বি ও মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৮ এএম
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১১ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দুর্নীতি-অনিয়ম

মন্ত্রীর এপিএসের দাপটে আটকে যায় তদন্ত

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. আরিফুর রহমান শেখ। ছবি : সংগৃহীত
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. আরিফুর রহমান শেখ। ছবি : সংগৃহীত

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রশিক্ষণের নামে প্রায় ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। সাতটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ৯টি চালানে এই অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়। ঘটনাটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে। দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক মো. আলী আকবর তদন্ত করেন। একদফায় অভিযুক্তদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন তিনি। তবে অভিযুক্তদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ও তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. আরিফুর রহমান শেখের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থাকায় তদন্ত কর্মকর্তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় তদন্ত কার্যক্রম। ফলে রাষ্ট্রের বিপুল টাকা তছরুপে যুক্ত থেকেও বহাল তবিয়তে অভিযুক্তরা।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তদন্ত কর্মকর্তা আবারও মতামত পেশ করেছেন কমিশনে। সেখানে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানী কর্মকর্তা পরিবর্তনের মাধ্যমে অভিযোগটির ওপর সুষ্ঠু অনুসন্ধান করা হলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯/৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা করা সম্ভব।

প্রাথমিক তদন্তে ২২ কোটি টাকা আত্মসাতে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তারা হলেন অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচাক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম আল মামুন, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর মো. লায়লা হাসান, অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর মো. আলমগীর হোসেন, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সুভাস চন্দ্র দাস, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সাবেক এপিএস ড. আরিফুর রহমান শেখ, তার ছোট ভাই থাইল্যান্ডের থামাসাট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজে কর্মরত শেখ আলতাফুর রহমান, থাইল্যান্ডে বসবাসরত সারফারাজ নেওয়াজ জিউস, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কনসালট্যান্ট ডা. জাবেদ আনোয়ার প্রমুখ।

প্রশিক্ষণ প্রকল্পের আওতায় কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ৪২৬ জনের থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার কথা ছিল। চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত ওই প্রশিক্ষণে কর্মকর্তা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদেরও পাঠানোর পরিকল্পনা করে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। যেখানে চিকিৎসকদের চেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাও ছিল বেশি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৫ জুন এক চিঠিতে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন (এমইঅ্যান্ডএইচএমডি) কর্মসূচির অনুমোদিত অপারেশনাল প্ল্যানের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮২ হাজার ৭২৩ ডলার পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। বৈদেশিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির টিউশন, ইনস্টিটিউশনাল ফি ও প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয়ভার হিসেবে এই অর্থ পাঠাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুরোধ করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাইয়ুম মিয়া, যা মালায়া ব্যাংকিং বারল্যান্ডের একটি হিসাবে পাঠানো হয়। একই দিন অন্য এক চিঠিতে একই ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালককে জরুরি ভিত্তিতে ৩২ হাজার ডলার পাঠাতে অনুরোধ করেন। একইভাবে ২৫ জুন এক চিঠিতে ১ লাখ ৫২ হাজার ডলার পাঠাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়। এ ছাড়া আরেক চিঠিতে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ৭২ হাজার ডলার ইন্দোনেশিয়ার একটি অ্যাকাউন্টে পাঠাতে বলা হয়। এখানেই শেষ নয়, বিদেশে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের নামে ইনস্টিটিউশনাল ফি ও প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয় হিসেবে ২০১৯ সালের ২৫ জুন ২ লাখ ২৪ হাজার ডলার এবং আরেক চিঠিতে চিকিৎসক প্রশিক্ষণের জন্য ৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার মালয়েশিয়ার ব্যাংকে পাঠাতে বলনে নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাইয়ুম মিয়া।

একইভাবে শ্রীলঙ্কার এক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০১৯ সালের ২৫ জুন ৩৬ হাজার ডলার, মালয়েশিয়ার এক অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৬৪ হাজার ডলার এবং মালয়েশিয়ার অন্য একটি অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৮৮ হাজার ডলার পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২০ জুন এক বিলে সই করেন চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের তৎকালীন লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। প্রশিক্ষণের নামে ২ লাখ ২৪ হাজার ডলার স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজ থামাসাট ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কাছে অগ্রিম টাকা চেয়ে পাঠানো বিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মালয়েশিয়ায় ৫৬ জনের প্রশিক্ষণের জন্য ১ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। টাকা পাঠাতে থাইল্যান্ডের স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজ থামাসাট ইউনিভার্সিটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়। অ্যাকাউন্ট নম্বর ৪৭৫-০-৭১৫৯৭-২ উল্লেখ করা হয়েছে। একই বিষয়ের ওপর আরেকটি আবেদনে ১৮৫ জনের মালয়েশিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা চাওয়া হয়। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে পাঠানো এ আবেদনের আইডি নম্বর ১৬২০১০১। এ ছাড়া ‘রিউমাটোলজি ও পুনর্বাসন, জরুরি রোগী ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক মালয়েশিয়ায় ৪১ জনের প্রশিক্ষণে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। এ দুই প্রশিক্ষণের জন্য পেট্রোনেজ ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট মালয়েশিয়া এসডিএন বিএইচডি নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর ৮৮৮১০২৬৮৮০৬৩২ উল্লেখ করে সেখানে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। কার্ডিওলজি, স্কিন্ড মেডিকেল ল্যাব, স্পাইন সার্জারি, জেরিয়াট্রিক বিষয়ে ৪৭ জনের প্রশিক্ষণের জন্য ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং অ্যাডভান্সড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং অন লিডারশিপ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স ফর ডেভেলপমেন্ট অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের ওপর মালয়েশিয়ায় ৮ জনের প্রশিক্ষণে ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। এই টাকা সে দেশের সিআইএমবি ইসলামিক ব্যাংক বারহ্যাডে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। অ্যাকাউন্ট নাম হিসেবে ইউটিএমস্পেস এবং নম্বর ৮৬০১৫১৮২২৮ উল্লেখ করা ছিল। বেসিক মেডিকেল সায়েন্স ও কমিউনিটি মেডিসিনের ওপর মালয়েশিয়ায় ২০ জনের প্রশিক্ষণের জন্য ৭০ লাখ ৩১ হাজার ৪৭২ টাকা চাওয়া হয়, যা মালায়ান ব্যাংকিং বারহ্যাড ব্যাংকের সিইউসিএমএস এডুকেশন এসডিএন বিএইডি ৫১২৪-৪৬২০-৪১৫৫ নম্বর অ্যাকাউন্টে পাঠাতে বলা হয়। ক্লিনিক্যাল স্পেশালিটি, ট্রেনিং অন এক্সপোজার ভিজিট অন রোলস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিস অব মেডিকেল প্রফেশনালস শীর্ষক শ্রীলঙ্কায় ৯ জনের প্রশিক্ষণে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টাকা চাওয়া হয়, যা কনকোয়েস্ট সল্যুয়েশন্স (প্রা.) লিমিটেডের হিসাবে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিসিএল এবং অ্যাকাউন্ট নম্বর ১০১৬২০০০০৪৩৫ উল্লেখ করা হয়।

এ ছাড়া পাবলিক হেলথের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা বিষয়ের ওপর ইন্দোনেশিয়ায় ১৮ জনের প্রশিক্ষণে ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। এ টাকা দেশটির ব্যাংক মান্দেরির লেমব্যাগা রিসেট কেশেহাটান নামের অ্যাকাউন্ট ১০৩-০০- ০৫১৩৩৫৮-৮ নম্বরে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। একই বিষয়ের ওপর একই দেশে আরও ৩৮ জনের প্রশিক্ষণে ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার টাকা সে দেশের ওসিবিসি এনআইএসপি ব্যাংকের পিটি এআইটি জে জারিং ইন্দোনেশিয়া নামে ৬৫১৮০০০০০৭৩৯ নম্বর অ্যাকাউন্টে পাঠাতে বলা হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ড. আরিফুর রহমান সেখের ভাই আলতাব হোসেন থাইল্যান্ডের স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজ থামাসাট ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করেন। এ কারণে অন্য দেশের প্রশিক্ষণের টাকাও তার ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। আলতাব হোসেনের মাধ্যমেই এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করা হয়।

ওই সময়ে থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী আলতাব হোসেন বলেছিলেন, খমসট ইউনিভার্সিটিতে দু-একটি দলের প্রশিক্ষণের কথা তিনি জানতেন। তবে সেই ইউনিভার্সিটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর বিষয় তার জানা নেই। মালয়েশিয়ায় এ ইউনিভার্সিটির কোনো শাখা নেই।

দুদকের অনুসন্ধানে দখা গেছে, নতুন নিয়োগ করা চিকিৎসকদের ১৫ দিনব্যাপী ‘বেসিক সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক স্থানীয় প্রশিক্ষণের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ কাটছাঁট করে ৪ কোটি টাকা বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রস্তাবটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তা অনুমোদন পায়। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিলে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সংশ্লিষ্টদের কাছে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের দিনক্ষণ নির্ধারণে চিঠি পাঠানো হয়। এতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জুলকিফিলি বিন ওসমান নামে এক ব্যক্তির কাছে পাঁচটি গ্রুপে ভাগ করে ৫৩ জনের তালিকা সংবলিত একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে তাকে ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার (ইউটিএম) ট্রান্সন্যাশনাল এডুকেশন ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একই দিন অন্য এক আদেশে মালয়েশিয়ায় আরও ১৭টি গ্রুপে ভাগ করে ২৫৯ জনের তালিকা দিয়ে ডেভিড বেনজামিন খোর নামে এক ব্যক্তির কাছে চিঠি পাঠানো হয়। তাকে ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়ার জিডি মাল্টিস্পেশালিস্ট হসপিটালের ইন্টারন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মালয়েশিয়ায় আরও ৬টি গ্রুপে ৪২ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়। চারটি গ্রুপে ৫৬ জনের তালিকা পাঠানো হয় থাইল্যান্ডের পাইখাই নওয়ামিন হাসপাতালের প্রফেশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (পিটিএম) ডিরেক্টরের কাছে। জানা গেছে, পিটিএম পাইঘাই নওয়ামিন হাসপাতালের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এটির মালিক বাংলাদেশি সরফরাজ নেওয়াজ জিউস।

অনুসন্ধানকালে আরও দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়ায় দুটি গ্রুপে ৪৩ জনের তালিকা পাঠানো হয় এশিয়ান ইন্টিগ্রেটেড ট্রেনিং নেটওয়ার্ক নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বিজায়ন্ত সোহেদির কাছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য ১৯টি বিষয়ের আওতায় ৩১ প্যাকেজে ৪২৬ জনের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানী ভাতা বাবদ ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৫ টাকা, বিমান ভাড়া ২ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর বাইরে টিউশন, ইনস্টিটিউশনাল ও প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয় হিসেবে ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৪৭২ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সব মিলে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ২১ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ১৪৭ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য জনপ্রতি ৪ হাজার ডলার বা ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হবে। পৃথক দেশের প্রতিষ্ঠান হলেও সবগুলোর ব্যয় একই ধরা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখায় বিগত কয়েক বছরের বিদেশে প্রশিক্ষণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারত, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বড় বড় নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের প্রশিক্ষণে পাবলিক হেলথের বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ দেড় হাজার ডলার এবং ক্লিনিক্যাল বিষয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার ডলার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় হতো। কিন্তু ওইবার সব প্রশিক্ষণের জন্যই ৪ হাজার ডলার করে ব্যয় ধরা হয়, যা আগের তুলনায় জনপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার ডলার বেশি এবং অস্বাভাবিক।

অনুসন্ধানে একটি জব্দ ইমেইল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওই বছরের ২৮ জুন ভোর ৫টা ৩১ মিনিটে ড. সেখ আলতাফুর রহমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামকে ইমেইল করেন। ইমেইলের বিষয় ছিল, ‘অফার লেটার টু কনডাক্ট ফর হেলথ প্রফেশনালস ইন মালয়েশিয়া।’ সাইবারজায়া ইউনিভার্সিটি কলেজ মেডিকেল সায়েন্সের (সিইউসিএমএস) পক্ষে ড. সেখ আলতাফুর রহমান এ ইমেইলে লাইন ডিরেক্টরকে প্রশিক্ষণের অফার লেটার পাঠান। নিজেকে তিনি থাইল্যান্ডের থামাসাট ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি মেম্বার এবং এইচএসএ/এলএলএইচওএস, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ-নেপাল-কম্বোডিয়ার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে পরিচয় দেন।

এ বিষয়ে দুদকের পক্ষ থেকে তদন্তকালীন ড. সেখ মোহাম্মদ আলতাফুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি থাইল্যান্ডে কতগুলো প্রোগ্রাম হয়েছে তা জানাতে পারেননি। তাকে থামাসাট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজের প্রোগ্রামের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। থাইল্যান্ডে আসা প্রশিক্ষণার্থীদের তিনি দেখভাল করেছেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার প্রোগ্রামের জন্য তাকে রিসোর্স পারসন হিসেবে নেওয়া হয়। তবে মালয়েশিয়ায় প্রশিক্ষণের টাকা থাইল্যান্ডে তার চাকরি করা প্রতিষ্ঠানে কেন গেছে, এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার মতামতে উল্লেখ করেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণে ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলামসহ অন্যদের বক্তব্য প্রদানে নোটিশ জারি করা হয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে তারা দুদক কার্যালয়ে হাজির হন। কিন্তু পরিচালক (বি। অনু: তদন্ত-৩) আমাকে অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ করে নথিটি উপপরিচালক মো. শামছুল আলমকে হস্তান্তর করতে মৌখিক নির্দেশ দেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদকে বক্তব্য প্রদানের জন্য নোটিশ করা হয়েছিল। ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার মতামতে আরও উল্লেখ করেন, অভিযোগটি অনুসন্ধানকালে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ব্যয়ের টাকা ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানোর দায়ে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজশ, প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ২১ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ১৪৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগটি দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/১০৯/৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের ৫(২) ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়। অভিযোগটির সুষ্ঠু অনুসন্ধান করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ এবং অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলামসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত করায় দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/ ৪৭১/১০৯/৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় একটি মামলা রুজু করা যাবে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের দুটি মোবাইল ফোনে ফোন করা হলে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামকে ফোন ও এসএমএম করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আক্তারুল ইসলাম বলেন, তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলী আকবর বর্তমানে দুদকে কর্মরত নেই। এই অভিযোদ পুনর্তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলে জানিয়েছেন। এরপর রোববার ও সোমবার তাকে ফোন করা হলেও সাড়া দেননি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পুলিশ বক্সে আশ্রয় নিয়েও বাঁচতে পারলেন না যুবদল কর্মী

অনলাইন শপিং ও গেমিংয়ে সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ছে : ক্যাসপারস্কি

বাউবির ITVET-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হলেন ড. শামীম

সাবেক সচিব লতিফুল বারির মৃত্যু

আবারও ইনজুরিতে নেইমার

চট্টগ্রামে ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নস অব দ্য এনভায়রনমেন্ট-২০২৫ অনুষ্ঠিত

বিয়েতে বেলুন বিস্ফোরণ, ভয়াবহ অবস্থা বর-কনের

মায়ের কুলখানি শেষে মারা গেলেন ছেলে

১ হাজার টাকার জন্য জীবন গেল শুভর

‘শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ পর্যালোচনা করা হচ্ছে’

১০

হোয়াইটওয়াশের পর নিজের ভবিষ্যৎ বোর্ডের হাতে ছেড়ে দিলেন গম্ভীর

১১

ভূমিকম্প / ঢাবির ৬ হলে কারিগরি নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্পন্ন

১২

গণসংযোগে জনস্রোত, আলিঙ্গনে সিক্ত নুরুদ্দিন আহাম্মেদ অপু

১৩

শিবির করায় ছাত্রত্ব বাতিল, একযুগ পর মাস্টার্সে পেলেন সিজিপিএ-৪

১৪

মানহানিকর বক্তব্য প্রচার নিয়ে আলী রীয়াজের বিবৃতি

১৫

১৪ দিন ধরে বন্ধ সোনাহাট বন্দর

১৬

ফেসবুকে নতুন সুবিধা, পরিচয় গোপন রেখেই আলোচনায় অংশ নেবেন যেভাবে

১৭

নিজ এলাকায় মিন্টুকে বরণ করতে উন্মুখ নেতাকর্মীরা

১৮

দুই দিন ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না তিন এলাকায়

১৯

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের নিচে নামল ভারত

২০
X