বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীল প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংক খাতের নানা ধরনের ঝুঁকির তথ্য উঠে আসছে। কয়েকটি অতি দুর্বল ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংক খাত আগামী দিনে চরম সংকটে পড়তে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে, অর্থনীতির আকারের তুলনায় দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি—দীর্ঘদিন ধরেই এমনটা বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। এরই মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংকের নামে নতুন করে আরও বেশ কিছু ব্যাংক অনুমোদন দিতে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ঋণ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত নীতিমালা জারির পর চাওয়া হয়েছে লাইসেন্সের আবেদন। ডিজিটাল ব্যাংক চালু হলে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাংকিং সেবা আরও সহজলভ্য হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন নেওয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথম ধাপে আবেদনের সময় গত ১ আগস্ট শেষ হলেও তখন কোনো প্রতিষ্ঠানই লাইসেন্সের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেনি। এরপর ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয় আবেদনের সময়।
গত বুধবার শেষ হওয়ায় সময়ের মধ্যে প্রচলিত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান, মোবাইল অপারেটরসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদন করেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত এক মাসে ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) প্রায় ৮০টি নামের ছাড়পত্র আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদনের মধ্যে একডজনেরও বেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, অন্তত দুটি এমএফএস প্রদানকারী ও দুটি মোবাইল অপারেটর রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য যত আবেদন পড়বে, তার সবকটিকেই অনুমোদন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক খাতের বর্তমান বাস্তবতায় নতুন করে আবার ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে অর্থনীতিবিদরা পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ বলছেন, ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় কোনোভাবেই দেশে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া উচিত হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, গণহারে সব আবেদন অনুমোদন না করে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সক্ষমতা আছে—এমন দু-একটি প্রতিষ্ঠানকেই অনুমোদন দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘নতুন করে আবার ব্যাংকের অনুমোদন কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার পরিধি কমে যায় এবং তারা গ্রাহকের কাছ থেকে বেশি চার্জ আদায় করে।’
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে দেশে প্রচলিত সব ব্যাংকই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা দিচ্ছে। তারপরও কেন ডিজিটাল ব্যাংকের প্রয়োজন? প্রচলিত ব্যাংকগুলো যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা দিচ্ছে, সেখানে কেন প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারছে না?’
তিনি বলেন, ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্ল্যুশন ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, মূলত আর্থিক সক্ষমতা না থাকার কারণেই প্রান্তিক পর্যায়ের অধিকাংশ মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। সেটা যদি মূল কারণ হয়, তাহলে ডিজিটাল ব্যাংকে কীভাবে তারা অ্যাকাউন্ট খুলবে?’
তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আগামী দিনে আমাদের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে যেতেই হবে। তবে ঢালাওভাবে না দিয়ে যাদের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সক্ষমতা আছে—এমন দুই থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এই অনুমোদন দেওয়া উচিত। যেখানে অনেক ব্যাংক এবং টেলিকম কোম্পানির সমন্বয় থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘আবেদন করা সব প্রতিষ্ঠানকেই অনুমোদন দিলে কিছু প্রতিষ্ঠান পয়সা খাটিয়ে টিকে থাকতে না পেরে বাদ হয়ে যাবে। কারণ, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বাজার খুব বড় নয়; কিন্তু এখানে বড় বিনিয়োগ লাগবে। ফলে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান মিলে কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে কাজ করলে ভালো হবে।’
তিনি বলেন, ‘সুশাসন ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঢালাওভাবে অনুমোদন দিলে এসব প্রতিষ্ঠানে অনেকের চাকরি হবে; কিন্তু প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়লে আবার তারা চাকরি হারাবে। অনেক ক্ষুদ্র গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিতে পড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় মূলধন প্রয়োজন হবে ১২৫ কোটি টাকা। পরিচালকদের কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী চলবে এই ব্যাংক। ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনো স্থাপনা থাকবে না। সব সেবাই হবে অ্যাপ-নির্ভর, মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সেবা দিতে হবে। গ্রাহকদের লেনদেনের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য দিতে পারবে। লেনদেনের জন্য কোনো প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না। অবশ্য এই ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকরা অন্য ব্যাংকের এটিএম ও এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। ডিজিটাল ব্যাংক কোনো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে না। বড় এবং মাঝারি শিল্পেও কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। শুধু ছোট ঋণ দিতে পারবে।
ডিজিটাল ব্যাংক চালু হলে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য সমস্যা হবে কি না—জানতে চাইলে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ডিজিটাল ব্যাংক সাধারণ ব্যাংকের মতো বড় আর্থিক লেনদেন করবে না। তারা এসএমই, রিটেইল এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগে প্রাধান্য দেবে। এখানে অনেক বেশি বিনিয়োগ করে ধীরে ধীরে এর কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এটি কখনোই প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য বাধা সৃষ্টি করবে না। বরং আরও প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য ভালো হবে।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ ব্যাংকিংয়ে যে ঋণ অনিয়ম হয়, এখানে তেমনটি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে ছোট ছোট ঋণ বিতরণ করবে। আর ব্যাংকগুলোতে যে অনিয়ম হয়, তার বেশিরভাগই হয় ব্যাংকের পরিচালকদের কারণে বা বড় বড় ঋণ দেওয়ার কারণে।’
ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকাশের শেয়ারহোল্ডাররা মিলে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের আবেদন করবে বলেও জানান সেলিম আর এফ হোসেন।
নীতিমালা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংককে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। আইপিওর পরিমাণ হতে হবে স্পন্সরের প্রাথমিক অবদানের ন্যূনতম পরিমাণের সমান।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, প্রান্তিক মানুষকে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যাংক হবে দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম ধাপে এজেন্ট ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। দালানকোঠা ছাড়াই যে প্রচলিত ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং সেবা পরিচালনা করতে পারে, সেটা আজ প্রমাণিত। সেখান থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই ডিজিটাল ব্যাংক চালু হচ্ছে। এখানে আরও উন্নতমানের প্রযুক্তি আসবে। ফলে এটিকে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবেই দেখছি। তবে কারা এই ব্যাংকের অনুমোদন পাবে, সেটিই বড় বিষয়। যারা মোবাইল ব্যাংকিংসহ প্রযুক্তিনির্ভর সেবা দিয়ে হাত পাকিয়েছে, অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’
মন্তব্য করুন