যুদ্ধবিরতি কার্যকরের সময় উচ্ছ্বসিত এক ফিলিস্তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দুঃস্বপ্নের দিন শেষ। কারণ এখন আর কোনো গুলি ও ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের তাড়া করবে না।’ তবে সে সময় পাশে থাকা আরেক ব্যক্তি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন, ‘আমি উচ্ছ্বসিত হতে পারছি না। কারণ ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো বিশ্বাস নেই।’ উচ্ছ্বাসহীন এ ব্যক্তির আশঙ্কাই যেন শেষ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একতরফা যুদ্ধ শেষে লাখো ফিলিস্তিনি যখন নতুন করে জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখছেন, তখন ভয়ংকর এক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন অঘটনঘটনপটিয়সী বলে পরিচিত এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কোনো রাখঢাক না করেই তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পুনর্বাসিত করার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার দখল নিতে চান তিনি। যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে গত মঙ্গলবার এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প এ পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণার পর বিশ্বব্যাপী উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। বিশ্বনেতারা বলেছেন, ট্রাম্পের এ ঘোষণা শুধু অনৈতিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীনই নয়, আন্তর্জাতিক আইনেরও বিরোধী। তবে লড়াকু ফিলিস্তিনিরা বলেছেন, তারা কোথাও যাবেন না। প্রয়োজনে মরবেন, তবু গাজা ছাড়বেন না তারা।
যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে গত মঙ্গলবার এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প গাজা নিয়ে যে পরিকল্পনার ঘোষণা দেন, তাতে হতবাক হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। নির্বাচনের আগে সব ধরনের যুদ্ধ-সংঘাত বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা থেকে যেন পুরোটাই সরে এসেছেন। কারণ গাজা নিয়ে তার এ ঘোষণা নতুন করে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে ফিলিস্তিসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে।
হতবাক করা সে ঘোষণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার দখল নেবে এবং আমরা এটিকে নিয়ে কাজও করব। আমরা এটির মালিক হব এবং সেখান থেকে সব বিপজ্জনক অবিস্ফোরিত বোমা ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার দায়দায়িত্ব নেব।’ ট্রাম্প আরও বলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয়, আমরা এটা করব। আমরা ভূখণ্ডটির দখল নিতে যাচ্ছি। আমরা এটির উন্নয়ন করতে চলেছি। এখানে হাজার হাজার কাজের সুযোগ তৈরি হবে এবং এটা এমন কিছু হবে, যার জন্য পুরো মধ্যপ্রাচ্য অনেক গর্বিত হবে।’ ট্রাম্প বলেন, ‘আমি একটি দীর্ঘমেয়াদি মালিকানা দেখতে পাচ্ছি এবং আমি দেখতে পাচ্ছি, এটা মধ্যপ্রাচ্যের এ অংশে দারুণ স্থিতিশীলতা বয়ে আনবে। আমি বেশ কয়েক মাস ধরে খুব নিবিড়ভাবে এ নিয়ে গবেষণা করেছি।’ তিনি গাজা সফরে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। তবে কবে নাগাদ যাবেন, সে বিষয়ে কিছু বলেননি। এর আগে ট্রাম্প আবারও জর্ডান, মিশর ও অন্যান্য আরব দেশকে গাজার বাসিন্দাদের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘গাজার বাসিন্দাদের সামনে উপত্যকাটি ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। গাজাকে ফের নির্মাণ করতে হবে।’ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কীভাবে ও কোন কর্তৃত্ববলে যুক্তরাষ্ট্র গাজার দখল নেবে, ট্রাম্প সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব দেননি। গাজায় কারা বসবাস করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, এটা বিশ্বের সব মানুষের বাড়ি হবে। গাজা দখলের পরিকল্পনা ঘোষণার কয়েকদিন আগে ট্রাম্প সেখানকার ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পুনর্বাসন করার প্রস্তাব দেন। ছোট্ট এ উপত্যকাকে ‘ধ্বংসস্থল’ বলে আখ্যা দেন। আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনের সে প্রস্তাব এরই মধ্যে প্রত্যাখ্যানও করেছে। সর্বশেষ ঘোষণায় ট্রাম্প বলেন, গাজাকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করতে চান তিনি। তবে কীভাবে তিনি এ উন্নয়ন ঘটাবেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি। গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণার পর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ট্রাম্প মাঝেমধ্যে ভবিষ্যৎ আলোচনা কোন পথে এগোবে, তা ঠিক করে দিতে চরম অবস্থান গ্রহণ করেন। নিজের প্রথম মেয়াদেও ট্রাম্প মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘোষণা দিয়েছিলেন, যেগুলো বৈদেশিক নীতির বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল। ওইসব ঘোষণার বেশিরভাগই ট্রাম্প কখনো বাস্তবায়ন করেননি।
প্রসঙ্গত ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে যুদ্ধের পর গাজায় এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। এ পর্যায়ে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ পরিকল্পনাকে মারাত্মক দায়িত্বজ্ঞানহীন বলছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, গাজার বাসিন্দাদের যদি জোর করে উচ্ছেদ করা হয়, সেটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে এবং শুধু এ অঞ্চলের দেশগুলোই নয়; বরং ওয়াশিংটনের পশ্চিমা মিত্ররাও এর জোর বিরোধিতা করবে। যুক্তরাষ্ট্র গাজার নিয়ন্ত্রণ নিলে তা ওয়াশিংটন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশের বহু দশকের গৃহীত নীতির পরিপন্থি হবে। এ নীতিতে বলা আছে, গাজা একদিন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ হবে এবং অধিকৃত পশ্চিম তীর এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সরকারের আমলে গাজায় মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি এড়িয়ে চলা হয়েছে। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে জাতিগত নিধনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে সরে যাওয়ার ট্রাম্পের আহ্বানকে ‘তাদের ভূমি থেকে বহিষ্কার’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এর নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, তারা এ অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা সৃষ্টির আয়োজন করছে। কারণ, গাজার বাসিন্দারা এ ধরনের পরিকল্পনা সফল হতে দেবেন না।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা : এদিকে সৌদি আরবসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘোষণার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সৌদি আরব সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদের যে কোনো উদ্যোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করবে না। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত আছে। আমরা দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করি।’ মার্কিন ডেমোক্র্যাট সদস্য এবং ফিলিস্তিনি-মার্কিন আইনপ্রণেতা রাশিদা তালিব বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা কোথাও যাবেন না। কংগ্রেসে গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলে দুই দলের সমর্থন থাকায় ট্রাম্প এমন চরমপন্থি কথা বলার সাহস পাচ্ছেন। দুই রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাসী সহকর্মীদের এখন সরব হওয়া উচিত।’ ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন বলেন, ‘২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করে গাজা দখলের প্রস্তাব জাতিগত নির্মূল ছাড়া কিছুই নয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউএসএর নির্বাহী পরিচালক পল ও ব্রায়েন বলেন, ‘গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমি। সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করা মানেই জাতি হিসেবে তাদের ধ্বংস করে দেওয়া। গাজায় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী কেবল ইসরায়েলি সরকার, যারা মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করে নির্মমভাবে বেসামরিকদের হত্যা করেছে।’ ইউএস মুসলিম অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস বলেছে, ‘গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বলপূর্বক উচ্ছেদ করলে তা হবে মানবতাবিরোধী অপরাধ। এতে যেমন আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ পাবে, তেমনি বিশ্বব্যাপী সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। আর বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের জাতিগত সম্মানের যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও উবে যাবে।’
কোথাও যাবেন না গাজাবাসী : এদিকে ট্রাম্পের এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় গাজাবাসী বলেছেন, তারা প্রাণ দেবেন তবু গাজা ছাড়বেন না। তিন সন্তানের এক জননী বলেন, ‘ট্রাম্প পাগল হয়ে গেছেন। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, আমরা ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের মুখেও গাজা ছেড়ে কোথাও যাইনি। আর ভবিষ্যতেও ছেড়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ সামির আবু বাসেল নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘ট্রাম্প জাহান্নামে যাক। সেইসঙ্গে জাহান্নামে যাক তার সব পরিকল্পনা, অর্থ ও অস্ত্র। আমরা গাজা ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। প্রয়োজনে প্রাণ দেব, তবু গাজা ছাড়ব না আমরা।’