গ্যাস সংকটে নরসিংদীতে বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনের অর্ধেক সময় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয়। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে রপ্তানিমুখী পোশাক খাত। বাতিল হচ্ছে বিদেশি অর্ডার। এতে শিল্প মালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। গ্যাসের এ সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলে এলেও কোনো সমাধান দিতে পারছে না তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। শিল্প মালিকরা বলছেন, কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এ অবস্থায় পোশাক রপ্তানি খাতে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
নরসিংদীর বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, বিদেশি বায়ারদের অর্ডার পূরণ করতে উৎপাদনের চাপে শ্রমিকরা যেখানে দম ফেলার সময় পেতেন না, গ্যাসের অভাবে মেশিন বন্ধ থাকায় এখন তারা অলস সময় কাটাচ্ছেন। নষ্ট হচ্ছে গুদামে মজুতকৃত কোটি কোটি টাকার কাপড়। শিল্প খাতে এখন পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে নরসিংদী। পাশাপাশি অসংখ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এ জেলায়। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পকারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার শিল্পকারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্পকারখানাগুলো চালাতে পারছে না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে শিল্পোদ্যোক্তারা। সামনে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এই ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছর দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের পোশাকের চাহিদা মেটায় নরসিংদীর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া বিদেশি বায়ারদের অর্ডার সঠিক সময়ে দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নরসিংদী জেলায় ছোট-বড় প্রায় দুই হাজার গ্যাসনির্ভর বস্ত্র কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার মাধবদী, চৌয়ালা, পাঁচদোনা, ঘোড়াদিয়া, বিলাসদী, শেখেরচর, শিবপুরের কারারচর বিসিক শিল্প এলাকার কারখানায় কাপড় রং করা, বয়লার চালানো ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে প্রতি ইউনিট ১১ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। তারপরও গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। আমাদের কারখানা কম্পোজিট প্রোজেক্ট। এখানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। গ্যাস সংকটে ডিজেল দিয়ে ডাইং কারখানায় উৎপাদন করা গেলেও স্ট্যান্ডার্ড ও ড্রাক করা যাচ্ছে না। আর ফ্যাব্রিক্স ডাইং করাতে না পেরে সুইং, ফিনিশিং, নিটিং অ্যান্ড প্রিন্টিং সেকশনের শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় পণ্য বিদেশে রপ্তানি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
তারা বলছেন, শিল্পকারখানার অবস্থা শোচনীয়। এমনিতেই গ্যাসের চাপ থাকে না। এখন তা আরও কমে গেছে। বিশেষ করে মাধবদী, চৌয়ালা, পাঁচদোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। গ্যাস সংকটে প্রতিদিন তাদের বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে। বিকল্প উপায়ে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিল্প উৎপাদন গভীর সংকটে পড়বে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শিল্পকারখানা বন্ধ হলে কিংবা বেতন দিতে না পারলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিল্প প্রতিষ্ঠানের জিএম বলেন, গ্যাসের সমস্যা রয়েছে, কিন্তু আমরা কিছু বলতে পারব না। কারণ আমাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে অফিস-আদালতে যেতে হয়, তখন আমাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আর এ কারণেই গ্যাসের সমস্যার ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে এতটুকু জেনে রাখেন, গ্যাসের সমস্যা রয়েছে। আমাদের এ কারখানার ক্যাপটিভ জেনারেটরের গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই। কিন্তু আমরা পাচ্ছি মাত্র ৩ থেকে ৪ পিএসআই গ্যাস। মাঝেমধ্যে শূন্য থেকে ২ পিএসআইয়ে গ্যাস আসে। তখন আর কারখানা ও জেনারেটর কোনোটাই চালানো যায় না। আমরা তখন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখি। পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে বিদেশি অর্ডার যথাসময়ে শেষ করা যাচ্ছে না এবং সময়মতো কাপড় রপ্তানিও করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ছাড়া বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে আমাদের কারখানায় উৎপাদন চালিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। লাইনে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় বাধ্য হয়ে বিকল্প জ্বালানির মাধ্যমে উৎপাদন চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
এমএমকে ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোমেন মোল্লা জানান, আমাদের প্রতিটি শিল্পকারখানায় ১৫ পিএসআই চাপে গ্যাস সরবরাহের অনুমোদন থাকলেও পাই ২ থেকে ৩ পিএসআই। এতে উৎপাদন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কম হচ্ছে।
নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট রাশেদুল হাসান রিন্টু বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পকারখানার সার্বিক উৎপাদন কমে এসেছে। এতে ডাইং ও শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো শিপমেন্ট (রপ্তানি প্রক্রিয়া) করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন বিদেশি বায়াররা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া দেশের ৭০ ভাগের বেশি মানুষের কাপড়ের চাহিদা মেটায় নরসিংদী জেলায় উৎপাদিত কাপড়। আর এ জেলায়ই যদি গ্যাস সংকট থাকে, তবে দেশ বড় বিপর্যয়ে পড়বে।
নরসিংদী বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মামুনুর রহমান বলেন, জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি নতুন করে চালু হওয়ায় সেখানে গ্যাস সরবরাহ দিতে হচ্ছে। আর সে কারণেই গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা আশা করি, দ্রুত এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।
মন্তব্য করুন