মরিশাসে অবস্থানকালে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান মাহমুদুল হাসান মুকুল ও নিপা আক্তার। দেশে ফিরে তারা গোপনে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান, যার নাম রাখা হয় তাকবির হোসেন। কিন্তু সন্তানের জন্মের তিন বছরের মাথায় মুকুল জড়িয়ে পড়েন এক নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে। বিষয়টি জানতে পারার পর নিপার ওপর শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। দিনের পর দিন সহ্য করতে না পেরে ২০২৩ সালের মে মাসে আত্মহত্যা করেন নিপা। এ ঘটনায় নিপার ভাই নাজমুল হোসেন মুকুল ও তার প্রেমিকা শান্তা আক্তারকে আসামি করে মামলা করেন।
নিপার মৃত্যুর পর মুকুল বিয়ে করেন সেই প্রেমিকা শান্তাকে। সন্তান তাকবিরকে তারা নিজেদের কাছে রাখেন। মামলাটি তুলে না নেওয়ায় নাজমুল হোসেনের অভিযোগ, তার ভাগনে তাকবিরের ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। সৎমা শান্তা এবং বাবা মুকুল প্রায়ই তাকবিরকে অমানবিকভাবে মারধর করতেন। শেষবার ২৫ মার্চ বিকেলে তাকবিরকে চড়-থাপ্পড় ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করেন শান্তা ও মুকুল। একপর্যায়ে শান্তা ভারী বস্তু দিয়ে তাকবিরের মাথায় আঘাত করলে সে রক্তাক্ত জখম হয়, ভেঙে যায় মাথার হাড়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকবিরকে ভর্তি করা হয় ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে। ছয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গত ৬ এপ্রিল রাতে মারা যায় সে।
তাকবির গুরুতর আহত হওয়ার পর গত ২৮ মার্চ সাভার মডেল থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন শিশুটির মামা নাজমুল হোসেন। মামলায় মুকুল, শান্তাসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ মুকুল ও শান্তাকে গ্রেপ্তার করলেও মুকুল জামিনে মুক্তি পান। বর্তমানে তাকবিরের মৃত্যুর ঘটনায় মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
নাজমুল হোসেন বলেন, ‘আমার বোন নিপা স্বামীর পরকীয়া জেনে ফেলেছিল, যেটা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মুকুল ও শান্তার যৌথ নির্যাতনে সে আত্মহত্যা করে। আমি আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করি, যা বর্তমানে বিচারাধীন। আমার ভাগ্নেকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা দেয়নি। বারবার মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল এবং হুমকিও দিয়েছিল। শেষমেশ আমার বোনের রেখে যাওয়া একমাত্র স্মৃতিকে তারা মেরে ফেলেছে।’
মুকুলের বাড়ি সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নে হলেও তারা দ্বিতীয় স্ত্রী শান্তাকে নিয়ে মোগড়াকান্দা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানেই ঘটেছে এই পাশবিক নির্যাতন। প্রতিবেশীরা জানান, আট মাস আগে তারা বাসায় ওঠেন এবং প্রায় প্রতিদিনই তাকবিরকে মারধর করা হতো। প্রতিবেশী আবু তাহের বলেন, ‘এমন নিষ্ঠুর সৎ মা জীবনে দেখিনি। প্রতিদিন বাচ্চাটিকে মারধর করত। সেদিন মেরেই ফেলেছে।’ আরেক প্রতিবেশী বলেন, ‘ঝগড়া করত স্বামী-স্ত্রী, আর মার খেত বাচ্চাটা।’
তাকবিরের চিকিৎসক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. কাজী ইকরামুল হক বলেন, ‘শিশুটির মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। মাথায় এমন জোরে আঘাত না করলে এভাবে রক্তক্ষরণ হতো না।’
মামলাটি তদন্ত করছেন সাভার মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. বিলায়েত হোসেন। তিনি জানান, ‘অভিযোগ পাওয়ার পরপরই আমরা মুকুল ও শান্তাকে গ্রেপ্তার করি। প্রথমে মামলা ছিল হত্যাচেষ্টা, কিন্তু শিশুটি মারা যাওয়ায় এখন হত্যার ধারায় রূপান্তরের আবেদন করা হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষ হলে মুকুলের জামিন বাতিলের আবেদনও করা হবে। তদন্তে অন্য কেউ জড়িত থাকলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।’
মন্তব্য করুন