বুধবার, ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
সঞ্জয় ঘোষ
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ মে ২০২৫, ০৭:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নজরুলজয়ন্তী আজ

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ—জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ‘বল বীর–/ চির উন্নত মম শির!/ শির নেহারি আমারি,/ নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!’—সমগ্র সাহিত্য জীবনে সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে এমনই বিদ্রোহী চেতনা ছড়িয়ে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানবতার কবি। জীবনে যতদিন সক্রিয় ছিলেন, ততদিনই নির্ভীক চিত্তে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তার ক্ষুরধার রচনা অব্যাহত রেখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন ছিলেন আপসহীন—খ্যাতির মোহের কাছেও কখনো মাথা নত করেননি। কারা নির্যাতনেও বিচ্যুত হননি সেই আদর্শ থেকে। বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া তুলনারহিত জনপ্রিয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনার মধ্য দিয়ে উপনিবেশবিরোধী সাহসিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন নজরুল। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে বহুমাত্রিক সৃষ্টির প্রাচুর্যে বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জীবনকে অতুলনীয় উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছেন নজরুল। তবে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবদান শুধু সাহসিকতার নয়, বরং তার সৃষ্টি দ্রোহ ও প্রেমের এক অসামান্য সংমিশ্রণ।

বিদ্রোহী চেতনার পাশাপাশি তিনি মানব হৃদয়ের কোমলতা ও প্রেমানুভূতির প্রতিও সমান আবেগে সাড়া দিয়েছেন। অজস্র গানে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলার সংগীত ভুবন। প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা গজল। কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটকসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার দখল ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে নজরুলসংগীত বাঙালির জাতীয় সংগীতের ধারায় এনে দিয়েছে শক্তিশালী আবেগ ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়। ধর্মীয় সহনশীলতা, নারীর মুক্তি ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের পক্ষে তার লেখা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে) ব্রিটিশশাসিত ভারতের অখণ্ড বাংলার বর্ধমান জেলায় আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। রাজনৈতিক উত্থান-পতনে নানা ভৌগোলিক বিভাজনের সূত্রে এক অর্থে ভিনদেশি হয়েও যে কারণে তিনি আজ আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত, এর পেছনে রয়েছে তার প্রতি ও তার সৃষ্টিকর্মের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং একই সঙ্গে এ দেশের মানুষের সঙ্গে তার নিজের সম্পৃক্ততা, সম্প্রীতি ও আক্ষরিক অর্থেই প্রেমের বন্ধন।

৯ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র ১০ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। অল্প বয়সেই নাট্যদলের জন্য লোকসংগীত রচনা করেছেন নজরুল। একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অন্যদিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবীকে নিয়ে প্রচুর শ্যামাসংগীতও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষণে উল্লেখ্য করেন—‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু, মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তৎকালীন ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন নজরুল। বলা যায়, নজরুলের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি এ করাচি সেনানিবাসেই। যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। ১৯২০ সালের দিকে সাংবাদিকতা শুরু করেন কাজী নজরুল। আর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।

জীবনের শুরু থেকে এ নানাবিধ কাজ ও পেশায় নিয়োজিত থাকার ভেতরেই নজরুল বিকশিত হতে থাকেন সাহিত্যে, সংগীতে, রাজনীতিতে। সৃষ্টি করতে থাকেন একের পর এক কালজয়ী রচনা। ১৯৩৮ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়ে একের পর এক গান লিখতে থাকেন। নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। নজরুল ‘ধূপছায়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন এবং আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি নজরুল। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে। তারপর থেকে দীর্ঘকাল অসুস্থাবস্থায় থেকে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলা সাহিত্যের এ অতুলনীয় প্রতিভা ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কবির স্মরণে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাতীয় পর্যায়ে কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও পালিত হচ্ছে নজরুলজয়ন্তী। আজ বিকেলে বাংলা একাডেমি আয়োজন করেছে নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠানমালা। এ আয়োজনে প্রদান করা হবে ‘নজরুল পুরস্কার ২০২৫’। এবার এ পুরস্কার পাচ্ছেন গবেষক আনোয়ারুল হক এবং সংগীতশিল্পী শবনম মুশতারী।

এদিকে, কাজী নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বাণীতে তিনি বলেছেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী সব স্বৈরাচারের জন্য আতঙ্ক হয়ে থাকবে। স্বাধীনচেতা এই মানুষটি সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবতার পক্ষে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক আপসহীন সংগ্রামী পুরুষ ছিলেন। জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে তার লেখনী ছিল সাহসী ও ক্ষুরধার। তিনি বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ ও কালজয়ী।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশের আকাশে চক্কর দিয়ে গেল ভারতের তিনটি ড্রোন

দ্রুত ডাকসুর ঘোষণা না আসলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি শিবিরের

অগ্রণী ব্যাংক ও ব্রাকনেটের মধ্যে প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত

সচিবালয়ে প্রবেশে বাঁধা অনাকাঙ্ক্ষিত : ইউট্যাব

সাবেক ভূমিমন্ত্রীকে বাসায় পাঠিয়ে দিল পুলিশ

আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা চরমোনাই পীরের

আর কোনো তালবাহানা নয়, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে : খোকন

পুরোনো ভুল থেকে শিখতে চান লিটন

নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ঘটনায় মহিলা পরিষদের উদ্বেগ 

সম্মেলন ছাড়াই লক্ষ্মীপুরে ছাত্রদলের ১০ কমিটি

১০

আলোচনা সভায় বক্তারা / ১০ মাসেও সরকারের মনের কথা বোঝা যাচ্ছে না

১১

রাজশাহীতে পরিত্যক্ত ‘রকেট লঞ্চার’ উদ্ধার

১২

সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তারের পর সেনা সদরের বার্তা

১৩

বগুড়ায় মিডিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন শহীদ শিমুল একাদশ

১৪

সুব্রত বাইনের উত্থান কীভাবে

১৫

রাবিতে এটিএম আজহারের মুক্তির প্রতিবাদে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের মশাল মিছিলে হামলা

১৬

ভারতীয় পুশইনের ক্ষেত্রে নীরব অন্তর্বর্তী সরকার : ১২ দলীয় জোট

১৭

ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশে বক্তব্য দিতে পারেন খালেদা জিয়া

১৮

গাজায় ‘বর্বরতা’ / প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে তিরস্কার করলেন জার্মান চ্যান্সেলর

১৯

জানা গেল আমিরাতে ঈদের তারিখ

২০
X