আজ ২৯ মে পালিত হচ্ছে ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস’। এ দিনটি বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মোৎসর্গকারী শান্তিরক্ষীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাতে নিবেদিত। শান্তির এই মহৎ যাত্রায় বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই একটি গর্বিত ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপীড়িত অঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশি সেনা, পুলিশ ও বেসামরিক সদস্যরা আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে শান্তির এক নির্ভরযোগ্য বাহিনী হিসেবে।
বিশ্বশান্তির এই মঞ্চে বাংলাদেশ আজ শুধু অংশগ্রহণকারী নয়, বরং জাতিসংঘের অন্যতম বৃহৎ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক গৌরবের অধিকারী। তাদের সাহস, পেশাদারিত্ব ও মানবিকতা বহুপথে প্রশংসিত হয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে। শান্তিরক্ষী দিবসের এই দিনে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে তাদের, যারা শান্তির পতাকা হাতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের আশার প্রতীক হয়ে।
তিন যুগের বেশি সময় ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের গর্বিত অংশীদার বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের বিরোধপূর্ণ দেশ ও স্থানে পরিচালিত জাতিসংঘের ১১টি মিশনের মধ্যে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা ১০টি দেশে নিয়োজিত আছেন। জনবলের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এ গৌরবময় অংশগ্রহণকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ২৯ মে পালিত হয়ে আসছে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস’। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য ‘দ্য ফিউচার অব পিসকিপিং’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় এ বছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উদযাপনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার সকালে শান্তিরক্ষীদের স্মরণের মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে সকালবেলা ‘শান্তিরক্ষী দৌড়/র্যালি-২০২৫’ উদ্বোধন করবেন। পরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আহত শান্তিরক্ষীদের সংবর্ধনা এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ উপস্থাপনার আয়োজন করা হয়েছে।
ইরান-ইরাকে সামরিক পর্যবেক্ষক দলে ১৫ জন সামরিক পর্যবেক্ষক পাঠানোর মাধ্যমে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে তার যাত্রা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯ সালে নামিবিয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী মোজাম্বিকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেয় এবং একই বছর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী বসনিয়া-হার্জেগোভিনিয়ায় শান্তিরক্ষায় তাদের সম্পৃক্ততা শুরু করে।
এ পর্যন্ত ২,০০,৫৫৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ৪৩টি দেশ ও অঞ্চলে ৬৩টি জাতিসংঘ মিশনে অংশ নিয়েছেন। এরই মধ্যে ৩,৬৪৫ জন নারী শান্তিরক্ষী সদস্য সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন এবং বর্তমানে ৪৪৪ জন নারী সদস্য শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কর্মরত রয়েছেন।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশ সফর করেছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ-পিয়ের ল্যাক্রোয়া। সফরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, পুলিশপ্রধান বাহারুল আলমসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি বিশেষভাবে চাই, শান্তিরক্ষা মিশনে আরও বেশি বাংলাদেশি নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক।
আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ল্যাক্রোয়া বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, আমরা নারীদের নির্দিষ্ট কিছু ভূমিকায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও আনসার সদস্যদের যুক্ত করার ব্যাপারে জাতিসংঘের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। জেনারেল জ্যঁ-পিয়ের ল্যাক্রোয়া বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের আওতায় বিভিন্ন দেশে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধে বিজিবি সদস্যদের পাঠাতে চায় বাংলাদেশ। তা ছাড়া মিশনে প্রশিক্ষিত আনসার সদস্যদের পাঠানোর ব্যাপক সুযোগ থাকায় এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একসময় শীর্ষে থাকলও এখন তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে—এমন তথ্য দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, নেপাল ও রুয়ান্ডা বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আমরা ফের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রথম স্থান পুনরুদ্ধার করতে চাই।
যেসব স্থানে নিয়োজিত বাংলাদেশিরা: বর্তমানে ১০টি মিশনে ৫৮১৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিয়োজিত আছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিআর কঙ্গোতে ১৯৮১ জন, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ১৪৭৫ জন, দক্ষিণ সুদানে ১৬৬৩ জন রয়েছেন। তা ছাড়া আবেই, সাইপ্রাস, লেবানন, লিবিয়া, ইউএসএ, পশ্চিম সাহারা ও ইয়েমেনে কিছু শান্তিরক্ষী আছেন।
মিশনে বাংলাদেশিদের আত্মত্যাগ: জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৬৮ জন বীর বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনী ১৩১, নৌবাহিনী ৪, বিমানবাহিনী ৯ ও পুলিশের ২৪ জন। দুঃসাহসিক এসব অভিযানে আহত হয়েছেন ২৭২ জন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৪১, নৌবাহিনীর ৯, বিমানবাহিনীর ৭ এবং পুলিশের ১৫ জন।
শান্তিরক্ষায় পুলিশ: জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ২১ হাজার ৮১৫ জন শান্তিরক্ষী ২৪টি দেশের ২৬টি মিশনে পেশাদারিত্ব ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের ২৪ জন শান্তিরক্ষী।
বর্তমানে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, সাউথ সুদান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ১২৮ জন পুরুষ ও ৭১ জন নারীসহ ১৯৯ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরা বিগত ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন। এরই মধ্যে ১ হাজার ৯২৭ জন নারী পুলিশ শান্তিরক্ষী বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন।
মন্তব্য করুন