সুশোভন অর্ক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ০৮:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইয়াবার চ্যালেঞ্জের মধ্যে চোখ রাঙাচ্ছে কোকেন

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস কাল
ইয়াবার চ্যালেঞ্জের মধ্যে চোখ রাঙাচ্ছে কোকেন

দেশে নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে মাদক হিসেবে ইয়াবা সেবনের চল শুরু হলেও ২০০২ সালে তা ল্যাবের পরীক্ষায় ইয়াবা হিসেবে পুরোপুরি চিহ্নিত হয়। ২৩ বছর ধরে ভয়ংকর এ মাদক দেশের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাও বলছে, দেশে প্রচলিত মাদকগুলোর মধ্যে ইয়াবার বিস্তার ঠেকানো তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এর ফাঁকে ছড়িয়েছে আরেক আলোচিত মাদক আইস (ক্রিস্টাল মেথ)। একই সঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে কোকেনের মতো ভয়ংকর মাদকও। এমন প্রেক্ষাপটের মধ্যেই আগামীকাল বৃহস্পতিবার পালিত হতে যাচ্ছে মাদকের অপব্যবহার ও পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস।

মাদক রোধে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর কর্তারা বলছেন, ইয়াবার চোরাচালান ও ব্যবহার ঠেকাতে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন ব্যস্ত, তখন সেই সুযোগে আন্তর্জাতিক চক্র ও দেশের অভ্যন্তরীণ মাদক কারবারিরা উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু অংশকে টার্গেট করে ছড়িয়ে দিচ্ছে কোকেন। একসময় বাংলাদেশকে ভয়ংকর এ মাদক পাচারের জন্য রুট হিসেবে ব্যবহার করা হলেও এখন দেশেই দিন দিন এর সেবনকারী বাড়ছে, যা বড় উদ্বেগের।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ বদরুদ্দীন কালবেলাকে বলেন, ‘ইয়াবা প্রতিহত করা এখনো আমাদের কাছে মূল চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে অস্থিরতার কারণে মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আসা কিছুটা বেড়েছে। ইয়াবার পাশাপাশি কোকেন চোরাচালানের ঘটনাও সম্প্রতি বেড়েছে।’

দেশে প্রচলিত মাদকের বাইরে নতুন বিভিন্ন ধরনের মাদকের বিস্তার ঘটছে বলে জানান জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ফেনসিডিলের পর ইয়াবার আগ্রাসন শুরু হয়। বর্তমান সময়ে কোকেনের অপব্যবহারও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এ ছাড়া এলএসডির মতো মাদকের অপব্যবহারও শুরু হয়েছে, যা শঙ্কার কারণ।’

মাদক নির্মূলে দেশে প্রকৃতপক্ষে তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অরূপ রতন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যার কারণে মাদকের ব্যবহার কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। মাদকের ব্যবহার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় এবং আধুনিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই।’

ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালে ডিএনসিসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২ কোটি ২৮ লাখেরও বেশি ইয়াবা জব্দ করে। তবে চলতি ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র চার মাসে এ মাদক জব্দ হয় ১ কোটি ৩৮ লাখেরও বেশি। এর আগে ২০২৩ সালে ৪ কোটি ২৯ লাখ, ২০২২ সালে ৪ কোটি ৫৮ লাখ এবং ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ পিসের বেশি ইয়াবা জব্দ করা হয়।

অবশ্য বরাবরই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, দেশের ভেতর ইয়াবার যে পরিমাণ চালান জব্দ করা হয়, প্রবেশের পরিমাণ তার আরও অন্তত কয়েকগুণ বেশি, যা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের মাদকসেবীদের হাতে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন সেবনকারীও।

ইয়াবা প্রবেশের রুট চিহ্নিত, তবে রয়েছে নজরদারির অভাব: মাদক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে মাদক পাচারের মূল কেন্দ্রে রয়েছে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার প্রবেশ। এ মাদক চোরাচালানের রুটগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বহুদিন ধরেই চিহ্নিত। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের পার্বত্য অঞ্চলসহ অন্তত ৩৫টি পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে ইয়াবার চালান। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো জানলেও কার্যকর নজরদারি নেই। চোরাকারবারিরা এসব রুটের পাহাড়ি পথ, সীমান্তের ফাঁকফোকর এবং খাল ও নৌপথ ব্যবহার করে নিয়মিত চালান আনছে।

ডিএনসির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘মাদক কারবারিরা নিত্যনতুন উপায়ে মাদক পাচার করছে। সেই তুলনায় আভিযানিক দক্ষতা আরও আধুনিক এবং ডিজিটাল করা না গেলে মাদক প্রবেশ ঠেকানো কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা মাদক পাচার রোধে যুক্ত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। যেসব মাদক কারবারি এসব অঞ্চল থেকে মাদক নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ধরা পড়ে, তারা কারাগারে গিয়ে আদালতের মাধ্যমে জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজ করে। সমন্বয়ের অভাবে তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয় না এবং এ কারবারিদের বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে আলাদাভাবে কোনো তথ্যও সংগ্রহ করে রাখা হয় না।’

ডিএনসির কক্সবাজার জেলার সহকারী পরিচালক সিরাজুল মোস্তফা জানান, ইয়াবার বিস্তার ঠেকানোই তাদের মূল চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া সম্প্রতি আইস ও কোকেনের মতো মাদক ঠেকানো তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে জনবল সংকট একটি সমস্যা।

এ প্রসঙ্গে ডিএনসির গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ বদরুদ্দীন বলেন, ‘আমাদের কিছুটা জনবল সংকট আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা সীমান্ত এলাকাসহ দেশের সব জায়গায় মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি।’

কোকেন চোরাচালান বেড়েছে কয়েকগুণ: ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ৯ বছর আগে ২০১৫ সালে ২ কেজি কোকেনসহ পেরুর এক নাগরিককে গ্রেপ্তারের পর এ মাদক নিয়ে তোলপাড় হয়। এরপর কোকেনের পাচার কিছুটা থামলেও গত বছরের জানুয়ারিতে ফের ঢাকায় বিমানবন্দরে প্রায় সাড়ে আট কেজি কোকেনসহ মালাউইর এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ে তিন কেজি ৯০০ গ্রাম কোকেনের একটি চালান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে পুরো বছরে দেশে ১৩ কেজি ৩ গ্রাম কোকেন জব্দ হয়, তবে পরের বছরই জব্দের তালিকায় তা ১৩০ কেজিতে দাঁড়ায়। এ ছাড়া চলতি বছর প্রথম চার মাসে ১০ কেজির বেশি কোকেন জব্দ হয়। সীমান্ত এলাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভয়ংকর এ মাদকের চালান জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ডিএনসির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কোকেনের বিষয়ে সতর্ক রয়েছি, এজন্যই মাঝেমধ্যে চালান ধরা পড়ছে। কিন্তু ইয়াবার চালান ঠেকাতে গিয়ে অন্যান্য মাদক নিয়ে আলাদা মনিটরিং করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে।’

কোকেনের বিস্তারের বিষয়ে ডিএনসির গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ বদরুদ্দীন বলেন, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে, আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদন কমে গেলেও মিয়ানমারে সেটির চাষ হচ্ছে এবং বাংলাদেশে তা সহজেই প্রবেশ করতে পারছে। তবে এ মাদকসহ অন্যান্য মাদকের অপব্যবহার ও পাচার ঠেকাতে তারা সতর্ক রয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি স্পষ্ট। তা ছাড়া মাদক ঠেকাতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেই। সমন্বয় বা কার্যকর ব্যবস্থা থাকলে দেশে এত ভয়াবহভাবে মাদকের বিস্তার হতো না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অস্ট্রেলিয়ায় জলবায়ু ভিসায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ

দেশে আজ থেকে স্বর্ণ বিক্রি হবে নতুন দামে

জি৭ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের যুগান্তকারী চুক্তি

জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলেন আ.লীগ নেতা

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে যে বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস

মালয়েশিয়ায় ৫ গাড়ির ভয়াবহ সংঘর্ষ

মুরাদনগরে নারীকে নির্যাতনের ঘটনায় আসিফ মাহমুদের স্ট্যাটাস 

নারীকে ন্যাড়া ও বিবস্ত্র করে খাটের সঙ্গে বেঁধে মারধর

কুমিল্লায় ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি ফজর আলী গ্রেপ্তার

আজ পরীক্ষায় বসবেন সেই আনিসা

১০

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড় 

১১

কুমিল্লায় নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, ভিডিও ভাইরাল করা তিনজন গ্রেপ্তার

১২

২৯ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৪

২৯ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

অপারেশন সিঁদুরে নেতৃত্ব দেওয়া সেই পরাগ হলেন ‘র’ প্রধান

১৬

ছায়া সংসদে বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন ইডেন মহিলা কলেজ

১৭

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ায় থানা ঘেরাওয়ের অভিযোগ

১৮

নানা সমস্যায় জর্জরিত বাঙলা কলেজের আবুল কাসেম ছাত্রাবাস

১৯

পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই : মেঘনা গুহঠাকুরতা

২০
X