বাংলাদেশের মঞ্চনাট্যে আবারও ফিরে এলেন বার্টোল্ট ব্রেখট। তার কালজয়ী নাটক Die Ausnahme und die Regel-এর অনুবাদ ‘ব্যতিক্রম ও নিয়ম’ গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ করল প্রাচ্যনাট। শহিদুল মামুনের অনুবাদ ও আজাদ আবুল কালামের নির্দেশনায় এটি প্রাচ্যনাটের ৪৩তম প্রযোজনা।
নাটকের কেন্দ্রে রয়েছেন সিন্দবাদ নামের এক বণিক, যিনি ব্যবসার খোঁজে বেরিয়েছেন বিপদসংকুল যাত্রায়। মরুভূমি, খরস্রোতা নদী আর অনিশ্চিত পথ পেরিয়ে তাকে পৌঁছাতে হবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। তার সঙ্গে রয়েছেন এক সাদাসিধে, পরিশ্রমী মজুর ও এক স্থানীয় গাইড। কিন্তু বণিক ক্রমেই হয়ে ওঠেন আত্মকেন্দ্রিক ও সন্দেহপ্রবণ। মনে মনে ভাবেন, তার সঙ্গীরা তার অর্থ ও দলিলপত্র নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। এক সময় তিনি গাইডকে বরখাস্ত করেন। তখন যাত্রাসঙ্গী থাকে শুধু মজুর।
যাত্রাপথে তীব্র গরমে যখন বণিক প্রায় মূর্ছিত হয়ে পড়েন, মজুর দয়া করে নিজের পানির পাত্র হাতে এগিয়ে আসেন। আতঙ্কিত বণিক মনে করেন, মজুর তাকে আক্রমণ করতে এসেছে, আর সেই ভয় থেকে তিনি গুলি চালিয়ে মজুরকে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় বিচারপ্রক্রিয়া। আদালতে দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের পর বিচারক রায় দেন—যেহেতু বণিক ‘যুক্তিসংগত কারণে ভয় পেয়েছিল’, তাই তার কাজ আত্মরক্ষার মধ্যে পড়ে এবং তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
এ রায়ের মধ্য দিয়ে ব্রেখট দর্শকদের সামনে এক তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন: আইন কাদের জন্য? ন্যায়বিচার বলতে আমরা কী বুঝি? ক্ষমতাবানের ভয় কি আইনি বৈধতা পেতে পারে, এমনকি যদি তার ফলে গরিবের প্রাণহানি ঘটে? নাটকটি দর্শকদের মনে এক গভীর অস্বস্তি তৈরি করে, এবং ন্যায় ও অন্যায়ের সীমারেখা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
অনুবাদক শহিদুল মামুন নাটকটির রূপান্তরে সৃজনশীল স্বাধীনতা নিয়েছেন, যাতে এটি বাংলাভাষী দর্শকের কাছে আরও সহজবোধ্য হয়। ব্যবসায়ীর নাম ‘সিন্দবাদ’ রাখায় পরিচিত রোমাঞ্চের আবহ তৈরি হয়েছে। সংলাপে এমন শব্দচয়ন করা হয়েছে, যা দর্শকের কল্পনায় মধ্যপ্রাচ্যের শুষ্ক মরুভূমি আঁকতে সাহায্য করে। অনুবাদক বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, ব্রেখটের নাটক বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পায়, বিশেষ করে যখন বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে ক্ষয়ে যেতে থাকে।
নাটকের নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম জানান, ব্রেখট চর্চা বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
সওদাগরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাখাওয়াত হোসেন রেজভী ও আহম্মেদ সাকী। কুলির চরিত্রে ছিলেন শতাব্দী ওয়াদুদ ও শাহীন সাইদুর। গাইড হিসেবে মঞ্চে দেখা গেছে ইয়াদ খোরশিদ ঈশান ও রকি খানকে। বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন অদ্রী জা আমিন, অনসূয়া চক্রবর্তী অপালা ও ডায়না ম্যারেলিন। এ ছাড়া নাটকে অংশ নিয়েছেন পরশ লোদী, তাপস সরকার রুদ্র, ফয়সাল কবির সাদি, তৌফিকুর রহমান রেইন, তাসনুভা কবির আদিতা, তাসফিয়া ফাইরোজ আনান, ঝুমকা মণ্ডলসহ আরও অনেকে।
মঞ্চ ও আলো পরিকল্পনা করেছেন মোখলেছুর রহমান ও শওকত হোসেন। সংগীত পরিচালনা করেছেন নীল কামরুল। কোরিওগ্রাফিতে স্নাতা শাহরিন এবং অন্যান্য দায়িত্বে ছিলেন নূরে জান্নাত ওরিশা ও ঝুমকা মণ্ডল। মঞ্চ নির্মাণ, পোস্টার, প্রচার, টিকিট ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন প্রাচ্যনাটের এক বড় দল।
প্রযোজনাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। সহযোগিতায় ছিল সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও দেশাল। বিপুল দর্শকের উপস্থিতি প্রমাণ করে, আজও ব্রেখটের নাটক আমাদের সমাজ ও সময়কে প্রশ্ন করতে সক্ষম।
মন্তব্য করুন