বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সৌদি আরব। গত দুই যুগে (২৪ বছর) ৩২৪ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছেন সে দেশের ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন খাতে সৌদি ব্যবসায়ীরা বড় পরিসরে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী। কিন্তু এক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে বিনিয়োগে ইচ্ছুক ব্যবসায়ীদের। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কয়েকটি দপ্তরের অসহযোগিতায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা। ফলে ঝুঁকিতে পড়ছে প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ, অনেকক্ষেত্রে প্রত্যাহারের শঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।
জানা গেছে, একদিকে সরকার যখন বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশ-বিদেশে জোর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তখন এর ঠিক উল্টো চিত্র সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে। এসব দপ্তরের অসহযোগিতায় বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন সৌদি আরবভিত্তিক বিনিয়োগকারীরাও। যার একটি নজির সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) লেখা সৌদি আরবভিত্তিক একটি বিনিয়োগ কোম্পানির চিঠি।
বিডার কাছে নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে গত ২১ আগস্ট চিঠিটি লিখেছে সৌদি আরবভিত্তিক বিনিয়োগ কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট। ওই চিঠিতে ২০১৮ সাল থেকে বর্তমান সময়ের মধ্যে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে ধরেছে কোম্পানিটি।
চিঠিতে ২০২১ সালে এস জেমকো নামে একটি যৌথ বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়, যেখানে বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন বাংলাদেশ জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সঙ্গে সৌদি প্রতিষ্ঠানটি প্রকৌশল সামগ্রী, এলিভেটর, সার্কিট ব্রেকার ও স্টিল স্ট্রাকচার উৎপাদনের চুক্তি করে। ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রথম ধাপে তারা ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এবং কারখানা স্থাপন করে।
কারখানাটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শেষে প্রতিষ্ঠানটি যখন বছরে ১০ হাজার ইউনিট প্রকৌশল ও বৈদ্যুতিক সামগ্রী উৎপাদনের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে সরকারি সিদ্ধান্তে নীতিগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০২১ সাল থেকে সেই কারখানা অচল করে রাখা হয়েছে।
এর আগে ২০১৮ সাল থেকে সৌদি কোম্পানিটি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠা করে ‘এসবিআইসিসিএল’ নামে একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সিমেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পে অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানির বদলে দেশেই উৎপাদনের উদ্যোগ নেয় এ প্রতিষ্ঠানটি। দৈনিক ১৫ হাজার টন (টিপিডি) ক্লিংকার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নামা প্রতিষ্ঠানটি মোট ৬০৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি করে সাড়া ফেলেছিল।
তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূত এবং সফররত সৌদি সরকারের মন্ত্রীও এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর উভয় দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক বাণিজ্যিক বন্ধন সুদৃঢ় করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) প্রতিশ্রুত ভূমি হস্তান্তরের বদলে অনাবশ্যক জটিলতা সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকায় অফিস স্থাপন, সার্ভে, অনুসন্ধান, সম্ভাব্যতা যাচাইসহ নানা খাতে সাড়ে ৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করার পর প্রকল্পটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে শুধু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে।
ওই চিঠির সূত্র ধরে আরও জানা যায়, দেশের চাহিদা মেটাতে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বর্তমানে কক্সবাজারের মহেশখালীতে খালাস করা হয় এবং জাতীয় পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। এটি এলএনজির একমাত্র প্রবেশদ্বার, বিধায় জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য আরেকটি এলএনজি প্রবেশদ্বার অপরিহার্য। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট।
৮৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তারা সৌদি আরব কিংবা অন্য দেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এরই মধ্যে স্থাপিত গ্যাস পাইপলাইন সম্প্রসারণ করে বাংলাদেশে সরবরাহের প্রস্তাব দেয়। এ উদ্দেশ্যে সরকারের সঙ্গে সৌদি রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়, যা দেশ-বিদেশের বহু প্রচার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানানো হয়।
চুক্তি মোতাবেক বেনাপোল ও যশোর হয়ে পাইপলাইনে এ এলএনজি দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহের কথা ছিল। এতে মহেশখালীভিত্তিক একমাত্র এলএনজি গেটওয়ের বিকল্প তৈরি হতো, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হতো। এ-সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতেও কোম্পানিটির ব্যয় হয় ৩ মিলিয়ন ডলার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিগত সরকারের অবহেলা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ প্রকল্পও ঝুলে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন, আতিথেয়তা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। সে কারণে সম্মত হওয়া বেশ কয়েকটি প্রকল্পেরও খুব বেশি অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন হয়নি। চ্যালেঞ্জের মূলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, যা বাংলাদেশে বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এ কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
তাদের মতে, সৌদি কোম্পানির পরপর তিনটি প্রকল্পে সৃষ্ট এমন বিরূপ পরিস্থিতি ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেয়। এখান থেকে উত্তরণের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করতে হবে। অন্যথায় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে কোনো সুফল আসবে না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিডার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি শুনেছি। সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অভিযোগকারী সৌদি আরবভিত্তিক কোম্পানির সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। যদিও বিষয়টি সৌদি ওই কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে, তারপরও জটিলতা নিরসনে বিডা সহযোগিতা করবে। এ ধরনের সমস্যা বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক; তাই সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।’
এদিকে দেশ ও কোম্পানির ভাবমূর্তি উদ্ধার এবং বাংলাদেশে এরই মধ্যে তিনটি বাধাগ্রস্ত বিনিয়োগে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কিছুটা পুষিয়ে নিতে সৌদি আরবের ওই ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট এবার নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। ওই প্রস্তাবে ঢাকাসহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জেট ফুয়েল পাইপলাইন ও জ্বালানি মজুদাগার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন ব্রিজ সংলগ্ন শীতলগঞ্জ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ এবং নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালসহ বিমানবন্দরের সুবিধাজনক স্থানে জেট ফুয়েল জ্বালানি মজুদাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ প্রস্তাবটিও সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীরা শতভাগ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
নতুন এ প্রস্তাবটি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা, বিমানবন্দরে আগত দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সের জ্বালানি সরবরাহ সুরক্ষা করা এবং জ্বালানি পরিবহন জড়িত ঝুঁকি ও আর্থিক ব্যয় সংকুলান নিশ্চিত করবে বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা। উভয় দেশের সুসম্পর্কের বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমান বিনিয়োগ প্রস্তাবটির বিষয়ে সরকারের, বিশেষ করে বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের সহায়তা প্রত্যাশা করে সৌদি আরবভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট।
মন্তব্য করুন