ঢাকা কাস্টম হাউসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েবের ঘটনার তদন্ত নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। এ ঘটনা সামনে আসার পর পৃথক দুটি কমিটি গঠন করে ঢাকা কাস্টম হাউস ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি কোনো কমিটিই। বরং আরও সময়ের আবেদন করেছে উভয়ই। মজার বিষয় হলো যে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এ অনিয়ম হয়েছে, ঢাকা কাস্টম হাউসের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে সেই কর্মকর্তাকেই। যাকে শোকজ করার কথা, তার হাতেই দেওয়া হয়েছে তদন্তের ভার। আর গুদামের সাবেক নিরীক্ষককে করা হয়েছে এনবিআরের কমিটির সদস্য সচিব। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কাস্টমসের ইতিহাসে ভয়াবহ এ স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় করা দুটি কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা। তাদের একজন হলেন ঢাকা কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার কাজী ফরিদ উদ্দীন। তিনি যখন হাউসের নিরীক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন, তখনই স্বর্ণ গায়েবের ঘটনা ঘটে। অথচ প্রতি মাসে তার গুদাম পরিদর্শন করে ঠিকমতো পণ্য আছে কি না, তা কমিশনার বরাবর জানানোর কথা। এ ছাড়া গুদামের চাবি যে দুই কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে ছিল, তাদের একজন নিরীক্ষক, আরেকজন হলেন গুদাম কর্মকর্তা। স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় সেই কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করে স্বর্ণ গায়েবের ঘটনা তদন্তের দায়িত্বের ভার দিয়েছেন ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পুরো ঘটনার তদন্ত শেষে কমিটির প্রধানের কোনো অবহেলা বা সংশ্লিষ্ট কমিশনারের কোনো দায় থাকলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কাস্টমসের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। যার কারণে এক মাস পেরিয়ে গেলেও মূলহোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি। ইতোমধ্যে থানায় করা ফৌজদারি এ মামলা ডিবি থেকে পিবিআইয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর আগে ঢাকা কাস্টম হাউস থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় দফায় দফায় কমিটি গঠন করে হাউস কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার একেএম নুরুল হুদা আজাদের মোবাইল ফোনে বারবার কল করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার ও গুদামের নিরীক্ষক কাজী ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ঢাকা কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, স্বর্ণ গায়েবের সময় ঢাকা কাস্টম হাউসের মূল্যবান গুদামের নিরীক্ষক ছিলেন এ অতিরিক্ত কমিশনার। তার দায়িত্বে থাকাকালীন এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটল, এসব কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব না করেই কমিশনার তাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করেছেন। আর এক মাসে এ তদন্তের অগ্রগতি এখনো আশাব্যঞ্জক নয় বলে জানিয়েছেন কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা। আর প্রাথমিক একটা তদন্ত দিয়ে কমিটির মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানোর আবেদন করা হবে বলেও নিশ্চিত করেছে সূত্র।
এনবিআরের জারি করা কাস্টমসের গুদাম ব্যবস্থাপনার স্থায়ী আদেশে বলা হয়েছে, গুদাম সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একজন নিরীক্ষক নিয়োগ করবেন সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসের কমিশনার, যিনি হবেন যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার ওপরের কর্মকর্তা। আর নিরীক্ষণ কর্মকর্তা প্রতি মাসের ৫ তারিখে গুদাম পরিদর্শন করবেন এবং পরিদর্শন প্রতিবেদন কমিশনার বরাবর দাখিল করবেন। আর সংশ্লিষ্ট কমিশনার ছয় মাস অন্তর গুদামের হালনাগাদ প্রতিবেদন এনবিআরে দাখিল করবেন।
আর নিরীক্ষকের দায়িত্বের বিষয়ে বলা হয়েছে, নিরীক্ষক দৈবচয়নের ভিত্তিতে গুদামে রক্ষিত আটক পণ্যের তথ্যাদি যাচাই ও নিশ্চিত করবেন। আর গুদামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট আছে কি না, তা যাচাই করে মূল্যবান গুদামের পরিস্থিতি প্রতিবেদন পাঠাবেন। আর শুল্ক গুদামের ব্যবহৃত রেজিস্টার যথাযথভাবে এন্ট্রি প্রদান ও সংরক্ষিত কি না যাচাই করবেন। আর নিরীক্ষাকালে পণ্য সংরক্ষণ ও অনলাইনে তথ্য বা আদেশ অনুযায়ী নিষ্পত্তিযোগ্য পণ্য ব্যবস্থিত না হলে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা পাঠাবেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব দায়িত্বে কোনোটাই ঠিকভাবে পালন করেননি এ দুই নিরীক্ষক। আর দায়িত্ব পালন করলে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটত না বলেও অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, কাস্টমসের ভয়াবহ এ ঘটনা নিয়ে শুরু থেকেই নীরব এনবিআর। এ ঘটনা সামনে আসার প্রায় ১০ দিন পর একটি তদন্ত কমিটি করে সংস্থাটি। এ কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের সদস্য ফারজানা আফরোজকে। আর সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউসের আরেক অতিরিক্ত কমিশনার মসিউর রহমানকে, যিনি এ ঘটনা ঘটার কয়েক মাস আগেও গুদামের নিরীক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। কাস্টম হাউসে ভয়াবহ এ ঘটনার আগে দুই গুদাম নিরীক্ষক এনবিআরের আদেশ ঠিকমতো পালন করেননি বলেও নিশ্চিত করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস সূত্র।
গত ২২ আগস্ট কালবেলায় প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর গুদাম পরিদর্শনে যান দুই মেয়াদে নিরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা এ দুই কর্মকর্তা। এ ছাড়া তারা দুজনই ঢাকা কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার। যারা বর্তমান কমিশনারের অধীনে কাজ করেন। আর যদি কমিশনারের কোনো দায়িত্বে অবহেলা থাকে, তারা কীভাবে প্রতিবেদন দেবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যার কারণে এনবিআর ও কাস্টমসের পক্ষ থেকে তদন্ত নিয়ে সন্দিহান অনেকে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্পের উদাহরণ দিয়ে এনবিআরের সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, কাস্টমসে একটি আইন করা হলো—একটি গেট দিয়ে কোনো হাতি যেতে পারবে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত হাতি যাচ্ছে, কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নতুন এক কর্মকর্তা এসে এক দিন একটি হাতি ছেড়ে দিলেন এবং একটি পশম ছিঁড়ে রাখলেন। এ নিয়ে সারা দেশে হৈচৈ। তদন্ত কমিটি হলো, ইনকোয়ারি কমিশন হলো। আরও কয়েকটি তদন্ত কমিটি হলো। পরে কর্মকর্তা বদল হতে লাগলেন, আর তদন্ত প্রতিবেদনের সময়ও বাড়তে লাগল। এক সময় কাগজের স্তূপ হাতির মতো হয়ে গেল। পরবর্তী সময়ে সবাই একমত হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলেন এ তদন্তের বিষয়টি তারা ক্লোজ করতে চান। আবেদনও গ্রহণ হলো। যা হওয়ার, তাই হলো। তাই এসব বিষয়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে বলেও মনে করেন এনবিআরের সাবেক এই চেয়ারম্যান।