সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৬। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৫। এ হিসাবে মোট যানবাহনের ৭২ শতাংশের বেশি মোটরসাইকেল। গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে দুই চাকার এ যানবাহন বেড়েছে অন্তত ১০ লাখ। নিহতের সংখ্যার দিক দিয়েও অল্প সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রথমে উঠে এসেছে। সড়কে এখন ৫০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হচ্ছে এ যানবাহনে। আর এসব মৃত্যুর শিকার ব্যক্তিদের একটা বড় অংশই তরুণ। এর বাইরেও দেশের সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তত ৬০ লাখ নিষিদ্ধ যানবাহন। এ পরিস্থিতিতে আগামীকাল রোববার পালিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৩।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বিশৃঙ্খলা, আইন না মানাসহ সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা। সব মিলিয়ে কোনো মানদণ্ডেই দেশের সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং গত ১৫ বছরে আরও অবনতি হয়েছে। নানা প্রণোদনা দিয়ে মোটরসাইকেল কেনায় উৎসাহ জোগানোর সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা প্রমাণ হয়েছে এই যানে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায়। এ অবস্থায় দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে না। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বিআরটিএ, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞসহ যাত্রী অধিকার আদায়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলেন, নিরাপদ সড়কের জন্য অন্তত ১১টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হলে পথের দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশে নিবন্ধিত যানবাহন থেকে অনিবন্ধিত বা অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। একই পথে চলে সব ধরনের যানবাহন। নিষিদ্ধ যানবাহনও চলে মহাসড়কে। সনাতন পদ্ধতিতে দেওয়া হচ্ছে যানবাহনের ফিটনেস। যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়াই মিলছে ভারী যানবাহনের চালকের লাইসেন্স। অদক্ষরা দিচ্ছে যানবাহনের রুট পারমিট। সেইসঙ্গে লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। মালিক-শ্রমিক ও আমলাদের প্রভাবমুক্ত করা যায়নি সড়ক পরিবহন আইন-২০২৩ থেকে। রোড সেফটি অডিট সম্পন্ন আন্তর্জাতিক মানের সড়ক নেই। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নেই বিআরটিএসহ পুলিশ বিভাগে। মালিক, শ্রমিককে আনতে হবে আইনের আওতায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশের পেক্ষাপটে নিরাপদ সড়কের জন্য চ্যালেঞ্জগুলো জানতে চাইলে সড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালবেলাকে বলেন, সচেতনতা ও আইন মেনে পথ চলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, আইন মেনে না চললে সড়ক নিরাপদ করা কষ্টকর। এতে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এজন্য চালক, পথচারী, মালিকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাহলেই দুর্ঘটনা কমবে। নিরাপদ হবে পথ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এআরআই) বলছে, টেকসইভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ১৫ বছরে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। উল্টো আত্মঘাতী কাজ করে সড়কে বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনা ও সড়কে মৃত্যু বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আগে পথচারী দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৪ শতাংশ। এখন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রধান কারণ মোটরসাইকেল। ৫০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হচ্ছে দুই চাকার এই যানে। নানাভাবে উৎসাহ আর প্রণোদনা দিয়ে এ যানটি সহজলভ্য ও জনপ্রিয় করে তোলার মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গত পাঁচ বছরে ১০ লাখের বেশি মোটরসাইকেল শুধুমাত্র রাজধানীতে বাণিজ্যিকভাবে অশুভ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে চলছে। এতে দেশের মূল জনশক্তি হিসেবে পরিচিত তরুণ প্রজন্মের মৃত্যু বাড়ছে, যা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এআরআইর পরিচালক ড. শামসুল হক কালবেলাকে বলেন, সরকার দুর্ঘটনা না কমিয়ে উল্টো কিছু আত্মঘাতী কাজ করে পথের মৃত্যু বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার গোঁজামিলের নানা হিসাব দিয়ে যাই বলুক; হিসাব হলো দুর্ঘটনা বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে মোটরসাইকেলের কারণে।
যানজট সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ জানিয়ে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশৃঙ্খল প্রতিযোগিতার আয়োজনে টেকসই কোনো সমাধান মিলবে না। একটি করিডোরে একটি কোম্পানি দিয়ে বাস চালাতে হবে। সেইসঙ্গে চালকের বেতন নিশ্চিত করতে হবে। মোটরসাইকেল না বাড়িয়ে গণপরিবহন বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের পরামর্শও দেন এই বিশেষজ্ঞ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, সড়ক বিভাগ, বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগ মুখে মুখে নিরাপদ সড়কের কথা বললেও তাদের কর্মকাণ্ডে তা চোখে পড়ে না। দুর্ঘটনা কমাতে পারে বিআরটিএ ও পুলিশের দপ্তরে এমন কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নেই। ৪০ লাখের বেশি নিষিদ্ধ যানবাহন দেশে চলছে। এসব যানবাহনের চালকের কোনো লাইসেন্স নেই, দেখারও কেউ নেই।
তিনি বলেন, নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন বাড়ছে। ২১টি মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন দেদার চলছে। তাছাড়া আইন প্রয়োগ নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও অভিযোগ আছে। সর্বোপরি সড়ক আইনকে এখনো মালিক-শ্রমিক ও আমলাদের প্রভাবমুক্ত করা যায়নি। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা কঠিন। তিনি বলেন, সিসি ক্যামেরা পদ্ধতিতে সড়ক আইনের প্রয়োগ করতে হবে। উন্নত দেশের মতো মালিক ও শ্রমিককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে সারা দেশে ৫ লাখেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসহীন গাড়ি রয়েছে। ফিটনেসহীন এসব বাহনের মধ্যে ৩০ শতাংশ রাস্তায় চলে না জানিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, পাশাপাশি রাস্তা উন্নত হওয়ায় ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওভার স্পিডের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ওভার স্পিড, দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন অপরাধে ড্রাইভারদের মার্কিংয়ে ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ করা শুরু হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ও বিআরটিএর পেশাদার চালকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চালকদের চক্ষু, রক্তচাপ ও র্যান্ডম ব্লাড সুগার পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বেশিরভাগ চালক উচ্চ রক্তচাপ ও চোখের সমস্যায় ভুগছেন। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক চালকের চোখের কন্ট্রাক্ট সমস্যাও পাওয়া গেছে।
নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ জন সড়কে নিহত হচ্ছেন। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তা করতে হলে আমাদের সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। তিনি বলেন, ‘পরিবহন মালিক থেকে শ্রমিক ও সড়ক ব্যবহারকারী—সবাইকে সচেতন হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু ঢাকা শহরে ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হলে ১০০ ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন। তবে আমাদের মাত্র পাঁচ থেকে ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। তাই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’
এদিকে গত ৯ মাসে সরকারি হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৮২৯ জনের প্রাণ গেছে। দিনে গড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১৪ জনের বেশি। বিআরটিএর মাসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪১০ জন, আগস্টে ৩৭৮, জুলাইয়ে ৫৩৩, জুনে ৫০৪,
মে-তে ৩৯৪, এপ্রিলে ৪৫৯, মার্চে ৫১১, ফেব্রুয়ারিতে ৩০৩ ও জানুয়ারি মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।