টেকসই অর্থনীতির চালিকাশক্তি হচ্ছে আর্থিক খাত। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থেকে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহের মাধ্যমেই দেশে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা বিকশিত হয়েছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সুবিধা পেয়ে উদ্যোক্তারা বড় হয়েছে। ছোট ছোট ঋণে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে ব্যক্তির সঞ্চয় ও ব্যবসার দৈনন্দিন অর্থ জমা হয় এসব প্রতিষ্ঠানে, যা ডলারে রূপান্তর হয়ে সচল রাখছে আন্তর্জাতিক বিনিময় লেনদেন তথা আমদানি-রপ্তানিও। তা ছাড়া সরকারের পরিচালন ব্যয়ের পাশাপাশি জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডেও প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করে এসব প্রতিষ্ঠান।
দেড় দশকের বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে আর্থিক খাতের পরিধিও বেড়েছে। দেশের ৬০টি ব্যাংক এবং ৩৩টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় কর্মকাণ্ড যেমন সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করেছে, তেমনি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নও বেগবান করেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘকাল জোরালো ভূমিকা রাখলেও কয়েক বছর ধরে হঠাৎ করেই সেই ধারায় ছন্দপতন ঘটেছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানো দূরের কথা, উল্টো বেহিসাবি পথচলায় বিনিয়োগ সম্পদের অবক্ষয়, সামগ্রিক আয় ও মুনাফা হ্রাস পাওয়ার দরুন অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেরাই এখন চলছে ধার করে। ব্যাংকে ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রবল হয়েছে। নিয়মনীতি ভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে ঋণ। সেই ঋণ কারও কারও হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্পূর্ণ সমঝোতার ভিত্তিতে, যা আর শোধ দেওয়ার প্রয়োজনবোধই করছে না। বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। এর বিপরীতে কেউ আবার ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ব্যবসার জন্য কাঙ্ক্ষিত মূলধনী ঋণ পাচ্ছে না। এরই মধ্যে যেসব ঋণ-বিনিয়োগ হয়েছে, তার কতটা উৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে; কতটা কর্মসংস্থান বাড়াতে পারছে— তারও মানদণ্ড খুব একটা বিবেচনায় আসছে না। কারণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক নীতি কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালন হচ্ছে না। সেখানে চেপে বসেছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্বৃত্তায়ন ও পেশিশক্তির প্রভাব। কার্যকর ভূমিকা রাখার পরিবর্তে পরিচালনা পর্ষদ ক্ষেত্রবিশেষে অনিয়মে সহায়তা করছে বলেও খবর বেরিয়েছে।
এ পর্যায়ে বেসরকারি খাতের জন্য শাপেবর হয়েছে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির পারদ— বাংলাদেশে যা এখন ডাবল ডিজিট ছুঁইছুঁই। আর এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণমূলক ৬/৯ স্তরের সুদহার তুলে দিতে বাধ্য হয় এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুদ্রানীতির কঠোর প্রয়োগে যায়। ফলে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে বেসরকারি খাতেও ঋণের প্রবাহ সংকুচিত করে দেয়। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ-বিনিয়োগও কমে যায়। এমন বাস্তবতায় চক্রাকার সমস্যায় আবর্তিত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারছে না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘সুশাসনের অভাব ও ব্যবস্থাপনা গত ত্রুটি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আর্থিক মন্দা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর পথ হলো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। যার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। তাহলে একদিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, অন্যদিকে ভোক্তার আয়ও বাড়বে। এতে চাহিদা বাড়বে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারিত হবে; কিন্তু সেই বিনিয়োগই বাড়ানো যাচ্ছে না।’
এ ধরনের সংকট উত্তরণের একমাত্র উপায় হিসেবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ থেকে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে অতিসত্বর উৎপাদনশীল খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ‘চেঞ্জ অব ফেব্রিক’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগের হারের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতের একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। এই বিনিয়োগ বাড়লে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে। এক্ষেত্রে কোনো দেশে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো গেলে সেই দেশে মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট পর্যন্ত বাড়ে। তবে ওই ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলে, অর্থাৎ খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে, ওই দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তখন উৎপাদনশীল খাতে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ব্যাহত হয় এবং এতে মোট দেশজ উৎপাদন কমে যায়।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩-এর তথ্যমতে, দেশীয় অর্থনীতিতে জিডিপির প্রায় ৯০ শতাংশজুড়েই রয়েছে ব্যক্তিখাতের ভোগ ও বিনিয়োগ; কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এখনো জিডিপির সর্বোচ্চ ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে স্থবির হয়ে আছে। অবশ্য এটা ২৮-২৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা রয়েছ। তবে বিদ্যমান ব্যবসার ব্যয় বৃদ্ধি থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা, মূল্যস্ফীতির চাপ ও ভোক্তাপর্যায়ে চাহিদার মন্দাসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাশিত ঋণ না পাওয়ার সীমাবদ্ধতা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের হার ও বিনিয়োগ তলানিতে নেমেছে।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতের ঝুঁকির বাস্তবতা তুলে ধরে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। চলতি বছর প্রকাশিত সংস্থাটির প্রতিবেদনে আগামীতে এই ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে এই সংস্থাটিও সংকট উত্তরণের উপায় হিসেবে আগে থেকেই ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে বেসরকারি খাত চাঙ্গা রাখার ওপর নজর দিতে বলেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একটা সময় বেসরকারি খাতে যখন ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশের সীমার কাছাকাছি ছিল- সেটি এখন ১০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ বেসরকারি তথ্যমতে, গত জুলাই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা আগস্টে কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে আরও কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে। অক্টোবরে সামান্য বাড়লেও তা ১০ শতাংশের সীমার মধ্যেই রয়ে গেছে। যদিও সরকার বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর ভাবনায় দীর্ঘদিন সুদের হার ৬/৯ স্তরে ধরে রেখেছিল; কিন্তু তাতে কিছু নিত্যপণ্যের আমদানি সুবিধা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি বেসরকারি খাতে।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী যখন নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগে গেছে, তখন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই পদক্ষেপ থেকে দূরে থেকেছে। এখন বৈশ্বিকভাবে যখন এটি ক্রমহ্রাসমান স্থিতিশীলতার চর্চা হচ্ছে, তখন নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগে গেছে সরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সেখানে মূল্যস্ফীতি অনিবার্যভাবে বাড়বে এবং বেসরকারি খাতে ঋণ-বিনিয়োগ কমবে এটাই স্বাভাবিক। এই ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই হয়েছে। আবার সেসব দেশ সুদহার বাড়ানোর নীতি কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই মূল্যস্ফীতি কমিয়েও আনতে সক্ষম হয়েছে; কিন্তু আমরা পারিনি। কারণ আমরা ঋণের সুদ ৬/৯ স্তরে ধরে রাখার জেদ ধরে বসেছিলাম। এতে কার কী লাভ হলো—সেটি আমার বোধগম্য নয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সেই সুদহার বাড়ানোর নীতিতেই ফিরে আসছে; কিন্তু মাঝখানে যা হওয়ার হয়ে গেছে।’
যদিও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলছেন ভিন্ন কথা। এ প্রসঙ্গে কালবেলার এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৬/৯ না থাকলে আজ দেশের ব্যাংকিং খাত খুঁজে পাওয়া যেত না। এসএমইর অস্তিত্ব থাকত না। মানুষ খাবার খেতে পারত না। দেশে খেলাপি ঋণের মাত্রা আরও বেড়ে যেত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই মূল লক্ষ্য। এতে যে নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ রয়েছে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণ-বিনিয়োগ কমবে। লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজনে আবারো সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে; কিন্তু এ মুহূর্তে এর বিকল্প নেই। তবে এটি যাতে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব না ফেলে সে লক্ষ্যে উৎপাদনমুখী ক্ষুদ্র ও কৃষি ঋণ বিতরণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আগের মতোই বহাল রয়েছে।’
যদিও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানিয়েছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ১৮ শতাংশ দেয় দেশের এসএমই খাতে। যা পায় মাত্র ৯ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৯১ শতাংশ এসএমই ব্যাংক ঋণের সহায়তা বঞ্চিত।
২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আর্থিক খাতে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের ঘোষণা দেয় বর্তমান সরকার। এর আওতায় ঘুষ, অনুপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, দুর্বৃত্তায়ন ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়; কিন্তু গত ৫ বছরে এসব বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নজরে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ১০.১১ শতাংশই এখন খেলাপি—টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি। ২০০৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, ‘যাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা, এসব অনাচার-অনিয়ম-দুর্নীতি-পাচার বন্ধ করার কথা, তারা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতাতেই এ কাজগুলো হচ্ছে।’