সপ্তাহব্যাপী টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব প্রধান নদনদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। যমুনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার শতাধিক বাড়ি, অসংখ্য গাছপালা ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ভাঙনের মুখে পড়েছে রাজবাড়ী জেলার বেশকিছু অঞ্চল। তিস্তার পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চর এলাকা ও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভয়-আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। এ অবস্থায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এতে সুরমা, যাদুকাটা, সারিগোয়াইন, সোমেশ্বরী নদীর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। কালবেলার প্রতিবেদক, ব্যুরো অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
যমুনার গর্ভে স্কুলসহ শতাধিক ঘরবাড়ি: যমুনার অব্যাহত ভাঙনে গত সাত দিনে সিরাজগঞ্জে চৌহালী উপজেলার তিন ইউনিয়নের ৯টি গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর, অসংখ্য গাছপালা ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অনেকে গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে পলিথিন টানিয়ে বসবাস করছে। বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চর নাকালিয়া, বিনানুই, চর সলিমাবাদ, ঘোড়জান ইউনিয়নের ফুলহারা, মুরাদপুর, চর ধীতপুর, উমারপুর ইউনিয়নের বাউশা, মিনিদা ও ধুবুলিয়া গ্রাম ব্যাপক ভাঙনের কবলে পড়েছে। সলিমাবাদ পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একতলা ভাবনের আংশিক গতকাল সকালে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
সলিমাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শাহীদুল ইসলাম অপু বলেন, পাঁচ বছর ধরে সলিমাবাদে যমুনার ভাঙন চলছে। এতে এ পর্যন্ত চার শতাধিক বসতবাড়ি ও ফসলি জমি যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চৌহালীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন রোধে অচিরেই বস্তা ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করা হবে।
রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীতে ব্যাপক ভাঙন: পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে ব্যাপক ভাঙন। বিলীন হচ্ছে শত শত একর ফসলি জমি। হুমকির মধ্যে রয়েছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। বিলীনের পথে প্রস্তাবিত ‘রাজবাড়ী সেনানিবাস’ এলাকা। গত কয়েকদিনের ভাঙনে রাজবাড়ী কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের এক কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। কৃষিজমি হারিয়ে কাঁদছেন পদ্মাপারের মানুষ। বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কয়েকদিন ধরে বেড়েই চলছে নদীর পানি।
সরেজমিন জেলার কালুখালীর রতনদিয়া ইউনিয়নের হরিণবাড়িয়া, লস্করদিয়া, চররামনগর, ভবানীপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বড় বড় চাপ নিয়ে নদীর পাড় ভাঙছে। নদীতে বিলীন হয়েছে কৃষিজমি। কৃষকের রোপণ করা পাট, বাদাম নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি পরিবার তাদের বসতবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল আমীন বলেন, পদ্মা নদীতে পানিবৃদ্ধি শুরু হয়েছে। কালুখালীর কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা ভাঙন কবলিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করছি।
তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে: গতকাল তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নীলফামারীর জলঢাকা, ডিমলা উপজেলা ও লালমনিরহাট জেলার চরাঞ্চলসহ নদীপাড়ের মানুষজন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ বাড়তে থাকে। গতকাল সকাল ৬টায় তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরে পানি প্রবাহ কিছুটা কমে বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচে রেকর্ড করা হয়। এতে তিস্তা ও ধরলা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। পানিতে তলিয়ে গেছে বাদাম, আমন বীজতলা ও সবজি ক্ষেত। লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, ভাঙনপ্রবণ এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, বন্যাকবলিত ইউনিয়নগুলোতে ৩০০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় যাবতীয় প্রস্তুতি রয়েছে।
সুনামগঞ্জের মধ্যনগরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত: ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ৬টি স্টেশনের মধ্যে ৪টিতেই পানি বেড়েছে। দুটি স্টেশনে পানি সামান্য কমেছে। জেলার মধ্যনগর উপজেলার সোমেশ্বরী, উব্দাখালী, মনাই নদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
মধ্যনগরের ইউএনও (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শীতেষ চন্দ্র সরকার বলেন, বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার জানান, সুনামগঞ্জ ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ০.৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে: নেত্রকোনার কলমাকান্দায় গত চার দিন ধরে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নদনদীর পানি বেড়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলার প্রধান উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ১৭ ঘণ্টায় উব্দাখালী নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ওই নদীর ডাকবাংলো পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া উপজেলার বৈঠাখালী, মঙ্গলেশ্বরী ও গণেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুল হক জানান, কলমাকান্দা-গোবিন্দপুর সড়কের বাউসাম রুমালীরবাড়ি সংলগ্ন এলাকায় সড়কটির কিছু অংশ পানিতে ভেঙে গেছে। এতে করে শনিবার সকাল থেকে ওই সড়কে যান চালাচল বন্ধ।
নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তীরবর্তী এলাকাসহ নিম্নাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখনো কোনো বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেনি। গ্রামীণ দু-একটি কাঁচা সড়ক ছাড়া কোনো সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার ভূমি মো. শহিদুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন