মলাটটা রঙিন; ঝকঝকে, চকচকে। কিন্তু মলাট উল্টালেই চোখ চড়কগাছ। বেশিরভাগ পাঠ্যবই ছাপা হয়েছে নিউজপ্রিন্ট কাগজে। এসব বইয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় অস্পষ্ট লেখা, রং লেপ্টে গেছে অনেক পাতায়। বইয়ে থাকা অনেক ছবিই স্পষ্ট নয়। সেগুলোতে রং ব্যবহার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মান ঠিক থাকেনি। আবার কিছু বইয়ে এক পৃষ্ঠার লেখা লেগে গেছে অন্য পৃষ্ঠায়। প্রাথমিকের বই উৎসবে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বই ঘেঁটে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই নতুন বছরের প্রথম দিনে বই উৎসবের রেওয়াজ ধরে রেখেছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। গতকাল সোমবার রাজধানীর মিরপুরে ন্যাশনাল (সকাল-বিকেল) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে কেন্দ্রীয় বই উৎসবের মাধ্যমে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে উচ্ছ্বসিত ছিল শিক্ষার্থীরা। তারা বিভিন্ন সাজে উৎসব প্রাঙ্গণে আসে। মিরপুরে বই উদ্বোধনের পর একযোগে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হয় বই উৎসব। যদিও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে অন্যান্য বছরের মতো জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন নেই।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় বই উৎসবে ২০টি সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩৮ জনের হাতে বইয়ের সেট তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। বাকিদের এক থেকে তিনটি বই দেওয়া হয়েছে। এর আগে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী।
অন্তত ২৫ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রাথমিকের বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে সেগুলো যাচাই করে দেখেছে কালবেলা। সেখানে ছিল সৃষ্টি প্রিন্টিং প্রেস, নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস, আলিফ প্রিন্টিং প্রেস এবং কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেসের বই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ কাগজে বই ছেপেছে আলিফ প্রিন্টিং প্রেস ও কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেস। তাদের বইগুলো ছাপা হয়েছে নিউজপ্রিন্ট কাগজে। তাদের সব বই-ই অস্পষ্ট লেখা ও নিম্নমানের ছাপা। সেই তুলনায় সৃষ্টি প্রিন্টিং প্রেস এবং নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেসের বইগুলো তুলনামূলক ভালো কাগজে ছাপা হয়েছে।
নিউজপ্রিন্টে ছাপা বই দেখে এগুলোকে ‘ডামি কপি’ ভেবেছিলেন মিরপুরের চম্পা পারুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রের অভিভাবক আবুবকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘এগুলো তো নিউজপ্রিন্টের কাগজে ছাপা বই। শুধু বই উৎসব করার জন্য এগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হয়েছে। উৎসব শেষে স্কুল থেকে ভালো বই দেওয়া হবে।’ তার এই ভুল ভাঙান সেখানে উপস্থিত ওই স্কুলের একজন শিক্ষিকা। তিনি বলেন, ‘এগুলোই আসল বই। নতুন করে কোনো বই দেওয়া হবে না।’
বইয়ের মানের বিষয়ে ন্যাশনাল (সকাল-বিকেল) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক মমিন হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আগে বইয়ের মলাটের মতো ভেতরের পাতাগুলোও চকচকে ছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে বইয়ের মান খারাপ হচ্ছে। ভেতরের লেখাগুলো স্পষ্ট নয়, ছবিগুলোও অস্পষ্ট। এসব বই এক বছর টিকবে বলে মনে হয় না।’
এ বিষয়ে জানতে কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেসের মালিক জানে আলম হাওলাদারের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এর আগে ২০২২ সালে নির্দিষ্ট সময়ে বই দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এই ছাপাখানাকে সতর্ক করেছিল এনসিটিবি।
এদিকে আলিফ প্রিন্টিং প্রেস নামে দুটি ছাপাখানার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দুটিই প্রাথমিকের বই ছেপেছে। জানতে চাইলে আলিফ প্রিন্টিং প্রেসের মালিক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার প্রেস থেকে ঢাকার কোনো প্রাথমিকে বই যায়নি।’ তবে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু বলেননি। আবার আলিফ প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিংয়ের মালিক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের প্রেসে উন্নত মানের কাগজে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে। খারাপ কাগজে কোনো বই ছাপা হয়নি।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় কালবেলাকে বলেন, ‘কিছু প্রতিষ্ঠান গত বছরগুলোর মতো এবারও নিম্নমানের কাগজে বই দিয়েছে। এরই মধ্যে তাদের কয়েক কোটি টাকার বই কেটে দেওয়া হয়েছে। পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন অনুযায়ী এসব ছাপাখানাকে জরিমানা করা হবে।’ তিনি বলেন, যারা ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট, তারা একপর্যায়ে গিয়ে ছাপাখানা মালিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। যে কারণে আগামী বছরের বই ছাপার টেন্ডারে থার্ড পার্টি না রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। তার বদলে সরাসরি ছাপাখানায় গিয়ে কাগজের নমুনা নিয়ে বিএসটিআই ও সায়েন্স ল্যাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া যায় কি না, সে চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এদিকে প্রাথমিক বই উৎসব করে এবং মাধ্যমিকে স্কুলে স্কুলে বই দেওয়া হলেও রাজধানীর স্কুলগুলোতে এ বছর নতুন বই নিতে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। শিক্ষকরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে এ বছর শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা আগেই শেষ হয়েছে। তাই অনেকে পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে গেছে। আর ৭ জানুয়ারি হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী নির্বাচনের পরে ঢাকায় আসবে। এ কারণেই উপস্থিতি কম।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হবে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৯ জন; প্রাথমিক স্তরের ১ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার ৫৯৪ জন এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৮৪ হাজার ৪৭৩ জন। সর্বমোট ২ কোটি ১২ লাখ ৫২ হাজার ৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৬০৬টি বই বিতরণ করা হবে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে বিতরণ করা হয়েছে ১৬০ কোটি ৭৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫২ কপি বই।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড জানিয়েছে, ২০১০ সাল থেকে শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই তুলে দেওয়ার সরকারের এ উদ্যোগটি ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। ১৩ বছরে সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৪৫০ কোটি বই। এদিকে মাধ্যমিকের কোনো কেন্দ্রীয় আয়োজন না থাকলেও, সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত বই বিতরণের কার্যক্রম চলেছে।
এনসিটিবি জানিয়েছে, মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ১ কোটি ৪ লাখ ৯০ হাজার ১০৭ জন, দাখিলের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৮ জন, ইংরেজি ভার্সন ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫৫ জন, কারিগরির ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৫২ জন, দাখিল ভোকেশনালের ৬ হাজার ১৫ জন ও ব্রেইল পদ্ধতির ৭২৪ জন নতুন বই পাবে। সর্বমোট ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার ৩৫৪ শিক্ষার্থী পাবে বিনামূল্যে নতুন বই।