রাজধানীর রামপুরার আরাফাত হোসেন মোবাইল ফোনে দৈনিক ২ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আয়ের বার্তা দেখে খণ্ডকালীন কাজ হিসেবে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হন। এরপর তিনি সেখানে ২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। তাকে ১ হাজার ২০০ টাকা লভ্যাংশ দেখিয়ে ২ হাজার ৮০০ টাক ফেরত দেওয়া হয়। এভাবে বিনিয়োগের বিপরীতে কয়েক দফা লভ্যাংশ দিলেও বড় অঙ্কের বিনিয়োগের পর তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শুধু আরাফাতই নন, তার মতো শত শত তরুণ অনলাইনে খণ্ডকালীন চাকরি বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের ফাঁদে পড়ে সব হারাচ্ছেন। এই তরুণদের প্রায় সবাই শিক্ষিত এবং তারা চাকরি খুঁজছিলেন। অনেকে স্বল্প বেতনে চাকরি করলেও আয় বাড়াতে অনলাইনে এই খণ্ডকালীন চাকরির ফাঁদে পড়ছেন। এর মধ্যে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
পুলিশের সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, খণ্ডকালীন চাকরি দেওয়ার নামে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন অ্যাপে আসা বিজ্ঞাপনগুলো দেশের বাইরে থেকে চালানো হয়। এতে দেশের কিছু মানুষ জড়িত। তারা এজেন্ট হিসেবে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে। তারা ব্যাংকগুলোতেও অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার টাকা আদায় করে। পরে তা চলে যায় বিদেশে। বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের অনেক দেশি-বিদেশি প্রতারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রতারক চক্রের সদস্য মোশারফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের সাইবার উইং। তার কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিয়ের নামে প্রতারণার বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে।
অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস শাখার এসপি মাহফুজুল আলম রাসেল বলেন, ফ্রিল্যান্সিং বা খণ্ডকালীন চাকরি দেওয়ার ফাঁদ পেতে চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগী আরাফাতের অভিযোগের ভিত্তিতে মোশারফকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর চক্রের আরেক সদস্য হিমেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। চক্রটি যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছে। অনেকেই এই চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে টাকা গচ্ছা দিলেও তারা পুলিশের দারস্থ হয়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, খণ্ডকালীন চাকরি বা ফ্রিল্যান্সিয়ের নামে অনলাইনে শত শত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরা নানা কায়দায় প্রতারণা করছে। কেউ কিছু পণ্যের ছবি দিয়ে তা প্রচারের দায়িত্ব দিচ্ছে। বিনিময়ে কিছু টাকা দিচ্ছে। একপর্যায়ে চাকরিপ্রার্থীকে নিজেদের টেলিগ্রাম অ্যাপে যুক্ত করে নানা অফার দিচ্ছে। সেই অফারে বিনিয়োগ করতে বলা হয়। শুরুর দিকে লভ্যাংশ দিলেও পরে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ নিয়ে তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আরেকটি গ্রুপ সরাসরি অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার অফার দিয়ে লভ্যাংশ দিচ্ছে। কয়েক দফা তা দিয়ে বিশ্বাস স্থাপনের পর বড় অঙ্কের বিনিয়োগ নিয়ে কেটে পড়ছে। বিভিন্ন সময়ে প্রতারক চক্রের এ দেশীয় এজেন্টদের আইনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। দেশে অবস্থান করা চক্রগুলোর অনেক প্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মূলহোতারা বিদেশে থাকায় ফের এরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন এক নারী। প্রাপ্ত বেতনে সংসার চলছিল না। তিনি হোয়াটসঅ্যাপে খণ্ডকালীন চাকরির অফার পেয়ে রেজিস্ট্রেশন করেন। ভালো আয়ের আশায় দুই দিনেই গচ্ছা দেন ৭০ হাজার টাকা, তাও ঋণ করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, প্রতারকরা টার্গেট করে শিক্ষিত বেকারদের। নিম্ন আয়ের চাকরিজীবীরাও টার্গেটে থাকে। দেশের বাইরে থেকে মূল প্রতারণা পরিচালিত হয়। চক্রের দেশীয় এজেন্টরা অশিক্ষিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন অপারেটরের সিম নিবন্ধন করে। সেই সিম ব্যবহার করে অর্থ লেনদেন করে। তিনি বলেন, যারা এই খণ্ডকালীন চাকরির অফারে সাড়া দেন, তাদের আরও যাচাই-বাচাই করা উচিত।