আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার পূর্বাভাসে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, ব্রহ্মপুত্রের পানি স্থিতিশীল আছে। অন্যদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এ ছাড়া পদ্মা ও অন্যান্য নদনদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
তিনি জানান, মনু, খোয়াই ও ধলাই ব্যতীত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদনদীগুলোর পানি হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং উজানের ঢল না থাকায় কুড়িগ্রামের দুধকুমোর, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে শুরু করেছে। অপরিবর্তিত রয়েছে তিস্তার পানি। পানি নিম্নাঞ্চল থেকে না সরায় ধরলা পাড়ের কয়েকটি জায়গায় এখনো জলাবদ্ধতা রয়েছে। এখানকার ফসলি জমি আর শাকসবজির ক্ষেত এখনো রয়েছে পানির নিচে।
সদরের ভোগডাঙ্গায় ধরলা পাড় সংলগ্ন পাড়ের বাসিন্দা কোবাদ আলী (৬০) কালবেলাকে বলেন, ‘পানি কাইল রাইত থাকি একন্যা কমলেও হামার বাড়ি এখনো তলে আছে আইজ চারদিন হইল।’ আরেক বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৫০) বলেন, ‘হামার ২টা ঘর, ২টা ঘরতে নদীর পানিত তলে আছে। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়া মানষের বাড়িত আছি আজ কয়দিন থাকি।’
শুলকুর বাজারের কৃষক গনি মিয়া (৬০) বলেন, ‘আমার ৩০ শতক জমিত পটোল আর ঝিঙা ক্ষেত সাত দিন থেকে পানির নিচে ছিল, গাছগুলো মরে গেছে। দুদিন হয় পানি নাই। আমার অর্ধেক আবাদ তুলতে পারছি। বাকিগুলো না তোলায় বড় ধরনের লোকসান হইছে এবার।’
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘উজানের ঢলে পানি না আসায় আর ভারি বৃষ্টি না হওয়ায় জেলার সব নদনদীর পানি গত বুধবার বিকেল থেকে কমতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী এক সপ্তাহ আপাতত বন্যার শঙ্কা নেই।’
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল না থাকায় কমছে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন নদনদীর পানি। এখনো তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার সড়ক ও ঘরবাড়িতে পানি রয়েছে। জেলার ৬টি স্টেশনের মধ্যে ৫টিতেই পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একমাত্র ছাতক স্টেশনে সুরমার পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। বসতভিটার ক্ষতি হওয়ায় এখনো সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে আছে অন্তত ৫০টি পরিবার। ঢলের পানিতে গ্রামীণ সড়ক এখনো ডুবে থাকায় ঘরবাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না মানুষ। এতে দুর্ভোগে ৬ উপজেলার বাসিন্দারা।
সদর উপজেলার পূর্ব সুলতানপুর গ্রামের আলিমা বেগম বলেন, ‘আমরার ঘরে হাঁটুসমান পানির জন্য ঘর ছেড়ে এসেছি, রাস্তায়ও পানি ছিল। আমরা গরিব মানুষ, বাঁশপালার ঘর, বন্যার পানি আসলেই ঘর এদিকে ভাঙে, ওইদিকে ভাঙে। কিন্তু কেউ আর ঘরটা মেরামত করে দিছে না, আমরা নিজেরাই করতে হয়েছে।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জে আপাতত বন্যার আশঙ্কা নেই। আগামী ২৪ ঘণ্টায় মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। কারণ এটি মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত। সুনামগঞ্জের সব নদীর পানি কমছে। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩ মিলিমিটার, লাউড়েরগড় পয়েন্টে ১৭ মিলিমিটার, ছাতকে ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, লালমনিরহাটে তিস্তাপাড়ে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। কাদা সৃষ্টি হওয়ায় প্লাবিত গ্রামের মানুষের চলাচল করতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
গতকাল সকাল ৬টা থেকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ধরলা নদীর পানিও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, বৃষ্টিপাত না হওয়া আর উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি আসা বন্ধ হওয়ায় দ্রুত কমেছে তিস্তার পানি। গতকাল সকালে তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তিস্তাপাড়ের চর ও নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। এখনো বেশকিছু এলাকার ঘরবাড়িতে পানি রয়েছে। আপাতত লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির কোনো শঙ্কা নেই।
লালনিরহাট সদর উপজেলার বাগডোরা গ্রামের ফাতেমা বেগম (৪৮) বলেন, বুধবার সকালে তাদের ঘরের ভেতর পানি ঢুকেছিল। রাতে নদীর পানি ঘর থেকে নেমে গেছে। এখনো বাড়ির উঠানে পানি আছে। নদীর পানি ঢুকে পড়ার কারণে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে কাদা। এজন্য চলাচল করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অংশে যমুনা নদীর ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। গতকাল সকালে উপজেলার বঙ্গবন্ধু সেতু-ভূঞাপুর সড়কে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী যমুনা পূর্ব পাড়ের ভাঙন কবলিত চিতুলিয়াপাড়া গ্রামবাসী এ বিক্ষোভ সমাবেশে করেন। চিতুলিয়াপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ, নুরুজ্জামান মাস্টার, আনোয়ার, তপুসহ স্থানীয় লোকজনের নেতৃত্বে এ বিক্ষোভ সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা নিজেদের ঘরবাড়ি ও বসতভিটা রক্ষায় ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জোর দাবি জানান।
পরে ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন ঘটনাস্থলে গিয়ে ভাঙন রোধে কাজ শুরুর আশ্বাস দিলে বিক্ষোভ তুলে নেন গ্রামবাসী।
গত কয়েক সপ্তাহে যমুনার ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন টাঙ্গাইলে ভূঞাপুরের যমুনা পূর্ব পাড়ের হাজারো মানুষ। চোখের সামনে নিমেষেই নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতভিটা, ঘরবাড়ি, ফসলি জমিসহ নানা স্থাপনা। ফলে নির্ঘুম রাত কাটছে ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের।
মন্তব্য করুন