প্রায় প্রতি রাতেই রাজধানীর ইস্কাটনের রাস্তায় মেজবানি খাবার বিক্রি হওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। খোলা ভ্যানে বড় বড় পাত্রে উন্মুক্ত অবস্থায় সেখানে দেখা মেলে গরু-খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট ও ঝালফ্রাই, কাচ্চি বিরিয়ানি, পোলাও, কাবাব ও বোরহানির মতো লোভনীয় খাবার। আশপাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টার। সেখানে আয়োজিত বিয়েশাদি বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের উদ্বৃত্ত খাবারের একাংশ চলে আসে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার হাতে। এ পর্যন্ত হয়তো ঠিকই ছিল, কিন্তু ব্যাপারটি অন্যভাবেও দেখার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কারণ ভালো মানের উদ্বৃত্ত খাবার সাধারণত আয়োজকরা নিজেদের বাসাবাড়িতে নিয়ে যান। তাহলে রাস্তায় কোথা থেকে আসে এত খাবার?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা অনেক রকম খাবারের ভিড়ে অনেকেই রোস্টে এক-আধটু কামড় বসিয়ে কিংবা ছিঁড়ে খেয়ে বাকি অংশ প্লেটেই রেখে দেন। একইভাবে সাধ করে প্লেটে তুললেও অনেকেই গরু বা খাসির মাংসের সবটুকু খেতে পারেন না। গ্লাসে ভরা বোরহানিও শেষ ধাপে গিয়ে থেকে যায়। পরে সেসব উচ্ছিষ্ট থেকে সচেতনভাবে লেগে থাকা অন্য খাবার সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর রান্নার হাঁড়িতে থেকে যাওয়া কিছু উদ্বৃত্ত অংশের সঙ্গে সেগুলো একাকার করে দেওয়া হয়। তখন যে অংশ ছিঁড়ে বা কামড়ে খাওয়া হয়েছে—তাতে ফের ঝোলের প্রলেপে মিশে যাওয়ায় উদ্বৃত্ত আর উচ্ছিষ্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। লোভনীয় স্বাদ-গন্ধেরও কোনো পরিবর্তন হয় না। যেগুলো রাস্তার পাশে সন্ধ্যারাতে নিয়ন বাতির আলো-আঁধারিতে বিক্রি হতে দেখা যায়।
শুধু ইস্কাটন নয়, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এমন দৃশ্য অনেকেরই চোখে পড়বে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওইসব রান্না করা খাবার কিন্তু অবিক্রীত থাকছে না। স্বল্প আয়ের অনেককেই অনেক কম দামে পলিথিনে করে সেগুলো পরিবারের সদস্যদের জন্য কিনে নিতে দেখা যায়।
অনুরূপভাবে রাজধানীর পাইকারি কাঁচাবাজার যাত্রাবাড়ী-কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারগুলোতে প্রায় প্রতিদিন দেখা মেলে একই রকম চিত্র। সেখানে বিক্রেতার বিক্রয়-অযোগ্য মাছ ও পচে যাওয়া আলু-পেঁয়াজ থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজি, ফলসহ অন্যান্য উচ্ছিষ্টও হয় ব্যবসা। ভাসমান বিক্রেতা সেগুলো বিনা পয়সায় কিংবা নামমাত্র দামে কিনে ভাসমান ক্রেতার কাছে খুব অল্প দামে বিক্রি করে পেট চালানোর অর্থ জোগায়।
এ ধরনের অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিরই কারণ নয়, দেহে রোগের বাসা বাঁধারও অন্যতম কারণ। অন্যদিকে টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের প্রধান উৎস হচ্ছে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার। এ কারণে নিরাপদ খাদ্যের সংজ্ঞায় স্বাস্থ্যবিজ্ঞান পচাবাসি, পরিত্যক্ত কিংবা উচ্ছিষ্ট খাদ্যের কোনোটিকেই নিরাপদ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত বা অনিরাপদ খাবার খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে। ফলে অনিরাপদ খাদ্যগ্রহণজনিত অসুস্থতায় প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই অনিরাপদ খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, যার থেকে মৃত্যুবরণ করছে ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে এখনো প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যের অনিশ্চয়তায় রয়েছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষই এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশেও অনিরাপদ খাদ্যের প্রবল ঝুঁকি রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যেও কারও কারও কাছে নিরাপদ খাদ্যের চেয়ে জীবন বাঁচাতে একটু সহজলভ্য দামে খাদ্য জোগাড় করাই বড় বিষয় হয়ে ওঠে। করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে তেল, চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, মাংস, দুধ, ডিমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে সরবরাহ ঘাটতি এবং দামের উত্তাপে সেটি আঁচ করা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পরিত্যক্ত বা উচ্ছিষ্ট খাদ্য কম দামে কিনে নেওয়ার এই মানসিকতা মূলত তারই বহিঃপ্রকাশ।
এই যখন পরিস্থিতি—তখন ‘স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সমৃদ্ধি চাই, নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নাই’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে দেশে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। দিনটি পালন উপলক্ষে দেশে সব শ্রেণির ভোক্তাপর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ঢাকায় র্যালি বের করা হবে। বিভিন্ন অংশীজন ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট থেকে এটি বের হওয়ার পর তা বিভিন্ন সড়ক ঘুরে কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে এসে শেষ হবে। সংস্থার চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম সরকার এর নেতৃত্ব দেবেন। ঢাকার বাইরেও দিবসটি পালনের কর্মসূচি থাকছে।
এদিন প্রতিটি জেলা সদরে স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবসাপর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ৭ কিংবা ৮ তারিখে খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী এবং দুই মন্ত্রণালয়ের সচিবদের উপস্থিতিতে নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনব্যাপী ঢাকায় সেইফ ফুড কার্নিভালের আয়োজন করা হবে।
এবার ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবসটি’ বিশ্বজুড়ে এমন এক সময়ে পালিত হচ্ছে যখন গোটা বিশ্বই মূল্যস্ফীতির উত্তাপে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছে। সামর্থ্যবানরাও এর উত্তাপ টের পাচ্ছে। এই অবস্থায় নিরাপদ খাদ্যের চেয়ে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম সরকার কালবেলাকে জানান, ‘উচ্ছিষ্ট, পরিত্যক্ত কিংবা পচাবাসী খাদ্য কোনোভাবেই স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। যেখানে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্ন উঠবে, সেখানে অবশ্যই নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। তবে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটি ওইরকম পরিস্থিতিতে নেই। অন্য অনেক দেশের তুলনায় খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাই দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত লক্ষ্যে জোরদার মনিটরিং, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, জরিমানা, সচেতনতামূলক কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ, জোন নির্ধারণ করে দেওয়াসহ নানারকম তৎপরতা অব্যাহতভাবে চলছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উচ্ছিষ্ট কিংবা পরিত্যক্ত খাদ্য বিক্রি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। এটা কোনোভাবেই বিক্রয় যোগ্য নয়। এটি বন্ধ করতেও কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।’
সাবেক খাদ্যসচিব ড. নাজমানারা খানম কালবেলাকে বলেন, ‘দেশ এখন উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথে। সেক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য আর খাদ্যের নিরাপত্তা দুটিকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে এগোচ্ছে সরকার। কেননা খাদ্য যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করেও তেমন লাভ হবে না। তখন অনেক ধরনের অসুখ-বিসুখের পেছনে টাকা-পয়সা ঢালতে হবে। হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স বাড়াতে হবে। আমরা যদি ওষুধ কেনার চেয়ে নিরাপদ খাবার কেনার পেছনে ব্যয় করতে পারি, তাহলেই কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। ফলে সরকার দুটিতেই নজর দিচ্ছে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো সায়েদুল ইসলাম বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তারই একটি অংশ হলো নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। এর জন্য সরকার কিন্তু খাদ্যপণ্যের নিরাপদ উৎপাদনেও জোর দিচ্ছে। গ্লোবাল ফুড প্রোডাকশনে যে গুড প্র্যাকটিসগুলো রয়েছে, সেই অনুযায়ী নীতিমালাও হয়েছে। একই সঙ্গে তার বাস্তবায়নে অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে কাজ চলছে। এতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার বিজ্ঞানভিত্তিক করা হয়েছে। পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে আইবিএম ব্যবহার বহুগুণ বেড়েছে, যা নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে।’