পাশ্চাত্যের ভালোবাসা দিবস আর বাংলার বসন্ত যেন প্রেমিকযুগল হয়ে আসে একই দিন। আগামীকাল বুধবার বসন্তের প্রথম দিন। সঙ্গে ভালোবাসা দিবস। এদিন বাড়তি পাওনা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা। এ তিনটি উৎসবেই প্রধান অনুষঙ্গ ফুল। একই দিনে তিন উৎসব ঘিরে ফুল বাজারে রমরমা অবস্থা। ব্যস্ত ফুল ব্যবসায়ীরাও। চাহিদা বাড়তি থাকায় আগেভাগেই শুরু হয়েছে ফুলের বাণিজ্য। এরই মধ্যে ফুলের দাম বেড়েছে তিনগুণ। এবার রেকর্ড ফুল বিক্রির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি বলছে, রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ১২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে।
শাহবাগে ফুলের বাজার ঘুরে জানা গেছে, ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির অধীনে শাহবাগে দেড় শতাধিক তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী পাইকারি ফুলের বাজারে নেতৃত্ব দেন। আর শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অধীনে আছে খুচরা ফুল বিক্রির অর্ধশতাধিক দোকান। এ ছাড়া ৩০ থেকে ৩৫টি অস্থায়ী খুচরা দোকান রয়েছে। মূলত ঢাকা শহরের ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ীরা এ পাইকারি মার্কেট থেকে ফুল কিনে সেগুলো দোকানে বিক্রি করেন। ঢাকার আশপাশের অনেক কৃষক সরাসরি এ মার্কেটে এসে ফুল বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে প্রতি রাতে তিন থেকে চারশ বিক্রেতা এখানে ফুল বিক্রি করতে বসেন। দোকানগুলোর পাশাপাশি রাস্তায় বসেও ফুলের ডালা, তোড়া বানানোর কাজ করতে দেখা গেছে কারিগরদের।
ঢাকায় ১৯৮৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে ফুল বিক্রি শুরু হয়। তখন বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে ফুল বিক্রি হতো। ১৯৯০ সালে শাহবাগে প্রথম ফুলের বাণিজ্যিক পাইকারি মার্কেট স্থাপিত হয়। এ ছাড়া কাঁটাবন, বনানী, গুলশান, উত্তরা, বারিধারা, আসাদগেট, ধানমন্ডি, মিরপুর, মহাখালী, বিজয় সরণি, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় দোকান, ফুটপাত এবং সড়কের পাশে ফুল বিক্রি হয়।
ফুল ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার পাইকারি পর্যায়ে প্রতি পিস ফুল ১০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে মানভেদে একটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৬০ টাকায়। জারবেরা ২০ থেকে ৫০ টাকা, গ্লাডিওলাস ২০ থেকে ৬০ টাকা ও রজনীগন্ধা ৫ থেকে ২০ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। এ ছাড়া ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এক হাজার গাঁদা ফুল। তবে খুচরা বাজারে একই ফুল বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। পাইকারি বাজারে সব ফুলের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা করে বেড়েছে। একটি গোলাপ ৩০ থেকে ৬০ টাকা, একটু বড় সাইজের গোলাপ ৫০ থেকে ১০০ টাকা, জারবেরা ৪০ থেকে ৭০ টাকা, গ্লাডিওলাস ৪০ থেকে ৭০ টাকা ও রজনীগন্ধা প্রতি স্টিক ২০ থেকে ৪০ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে।
রিমন মাহমুদ নামে এক ক্রেতা বলেন, ফুল হয়ে গেছে সোনার হরিণ। দুদিন আগেও যে গোলাপের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তা আজ (সোমবার) কিনেছি ৬০ টাকায়। বুধবার এই গোলাপ ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হতে পারে। সাধারণ একটা ফুলের তোড়া আড়াইশ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে। এটা বাড়তি হয়ে যায়। ফুলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট আছে।
১৯৯৪ সাল থেকে শাহবাগে ফুল ব্যবসা করেন জামাল হোসেন। তিনি বলেন, তিনটি উৎসব তিন দিনে হলে ব্যবসা আরও ভালো হতো। ফুলের দোকান দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সাধারণত বড় দোকানে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। আর ছোট দোকানে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হয়। ফুল ব্যবসায়ী মোখেলেছুর রহমান বলেন, এবার ফুলের বিক্রি খুবই ভালো হচ্ছে। দোকানে ৫০ রকমের ফুল রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ রকম ফুল বিদেশি।
শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ কালবেলাকে বলেন, ‘বাগান মালিকরা ফুলের দাম বাড়িয়ে রেখেছেন। বাগানে গোলাপের দাম ৩০ টাকা রাখা হচ্ছে। করোনার আগে শাহবাগে ৫০টি খুচরা দোকানে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতো। এ বছর এক থেকে দেড় কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে। প্লাস্টিকের কৃত্রিম ফুলের চাহিদা বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।
এ বছর ফুল বিক্রিতে মুনাফা ভালো হবে বলে জানান শাহবাগভিত্তিক পাইকারি ফুল বিক্রেতাদের সংগঠন ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেরিন শেখ। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে এমনিতেই ফুল বিক্রি বেশি হয়। তবে ফুলের দাম এবার তিনগুণ বেড়েছে। ঢাকার বাজারে অধিকাংশ ফুলই আসে যশোরের গদখালী, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ ও সাভারের গোলাপ গ্রাম থেকে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, চীন ও ভারত থেকেও ফুল আমদানি করা হয়।’
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি বাবুল প্রসাদ কালবেলাকে বলেন, ‘এবার একই দিনে পহেলা ফাল্গুন, সরস্বতী পূজা এবং ভালোবাসা দিবস। এ কারণে চাহিদা বেশি থাকায় ফুলের দাম বেড়ে গেছে। দাম বাড়তি হওয়ায় বাণিজ্যের হিসাবও বেড়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘিরে রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ১২০ কোটি টাকার মতো ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’
তিনি বলেন, ‘তিন উৎসবের ফুলের চাহিদা এক দিনে পূরণ করা কষ্টকর। সবাই চাইবেন ফুল সংগ্রহ করতে। সেক্ষেত্রে ফুলের দামটাও চড়া থাকবে। করোনার দুই বছর অনেকের লোকসান হয়েছে। আমরা আশা করছি, দু-এক বছরের মধ্যে দেশে ফুলের বাজার দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে।’
গদখালীতে গোলাপের দামে ধস
যশোর ব্যুরো জানায়, যশোরের গদখালীতে গোলাপের দামে আবার ধস নেমেছে। দাম কমেছে মানভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত। গতকাল গোলাপ বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস ১২ থেকে ২৫ টাকায়। এক দিন আগেও বিক্রি হয়েছিল মানভেদে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। চায়না গোলাপের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
এদিন প্রতি পিস রজনীগন্ধা বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। রঙিন গ্লাডিওলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। এ ছাড়া জারবেরা ১৫ থেকে ২০ টাকা; চন্দ্রমল্লিকা ৩ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি হাজার গাঁদা ফুল ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছে। গত সপ্তাহে এ ফুল ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
নীলকণ্ঠনগর গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, অনেক চাষি গোলাপ বিক্রি করতে পারেননি। ভোরের বাজারে ২০ থেকে ২২ টাকা বিক্রি হলেও পরে দাম কমে যায়। গোলাপে পচন রোগের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটু বেশি দাম পাওয়া গেলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী কৃষকের পেটে লাথি মারার জন্য গোলাপ আমদানি করেছেন।
গতকাল পানিসারা গ্রামের কৃষক আরিফ হোসেন বলেন, সাড়ে ছয় হাজার গাঁদা ফুল নিয়ে হাটে এসেছি। প্রতি হাজার ফুল বিক্রি হয়েছে ৬৫০ টাকা দরে। আগে দাম ছিল ১৫০ টাকা দরে। বেনেয়ালি গ্রামের শহিদুল গাজী বলেন, ১০ হাজার গাঁদা ফুল নিয়ে এসেছি। প্রতি হাজার বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘সোমবার গদখালী বাজারে অন্তত ২০ হাজার বিদেশি গোলাপ ঢুকেছে। ঢাকার বাজারে আরও বেশি ঢুকেছে। এজন্য চাষিরা গোলাপের দাম কম পেয়েছেন। গদখালী বাজারে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। অনুকূল পরিবেশ থাকলে ১০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে।’