এবারের হাড় কাঁপানো তীব্র শীতের দিন পেরিয়ে প্রকৃতিতে এখন মোলায়েম হাওয়ার রাজত্ব। সকালের মিষ্টি রোদে মৃদু হাওয়ার দোলায় ঝরতে থাকে একটি-দুটি হলদে পাতা। এমনই এক বাসন্তী প্রভাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই রমনা পার্কে। রাজধানীর ফুসফুসখ্যাত এ উদ্যান তখন পাখির কিচিরমিচিরে মুখর। মৎস্যভবন ফটক দিয়ে পার্কে প্রবেশ করতেই অভ্যর্থনা জানাল একঝাড় পান্থপাদপ। এর লাগোয়া দুটি উদাল গাছের ডালে ডালে যেন রঙের মেলা বসেছে। শীতে পুরোপুরি নিষ্পত্র ডালে হলদে-সোনালি ফুলের শোভা ভীষণ নজরকাড়া। গাছের তলায় শুকনো পাতার মর্মর। ফাল্গুনের শুরুতেই যেসব ফুল নিজেদের বিপুল উচ্ছ্বাসে মেলে ধরে তাদের মধ্যে অন্যতম এ উদাল।
আরেকটু সামনে এগোতে নজর কাড়ল রক্তকাঞ্চন গাছে ফুলের প্রাচুর্য। রক্তকাঞ্চনও প্রকৃতিতে বসন্তের বার্তাবাহী। সবুজ পাতার সঙ্গে গোলাপি-বেগুনি ফুলের এই উজ্জ্বল প্রস্ফুটন ফাগুনের প্রকৃতিতে বাড়তি পাওয়া। অপূর্ব সুন্দর রক্তকাঞ্চনের গাছ চেনা যায় তার পাতা দেখে। এর সজোড় দুটি পাতা যেন উড়ে চলা সবুজ প্রজাপতি। গোলাপি রঙের ‘রক্তকাঞ্চন’ ছাড়াও ফুটেছে সাদা রঙের একটি কাঞ্চন। রং ভিন্ন হলেও এরা একই প্রজাতির। রমনার একই অঙ্গনে দেখা মিলল কাঞ্চনের আরেক নিকটাত্মীয় অর্কিড কাঞ্চনের।
‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে’; কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার মতোই রমনায় মাধবীলতার ঝাড়গুলোতে দেখা গেল ফুলের মিছিল।
বাতাসে ভেসে আসছিল হালকা মিষ্টি সুবাস। গান-কবিতায় যতটা আছে, সেভাবে প্রকৃতিতে টিকে নেই আমাদের এক সময়ের বন-পাহাড়ের এই ফুল। বাংলার পুষ্প ঐতিহ্যের ধারক মাধবীলতার (Hiptage benghalensis) ফুল দেখতে চাইলে ফাগুনের প্রথমভাগেই নিবিড় চোখ রাখতে হয়। কারণ, ‘মাধবী এসে হেসেই বলে, যাই যাই যাই।’
কেবল ফুল কেন, কোনো কোনো গাছের পাতাও রঙের যে ঝরনাধারা বইয়ে দেয়, তার সৌন্দর্য কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। পার্কে দীর্ঘ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা নাগেশ্বরের ডালে ডালে তামাটে কচি পাতার নাচন চোখে যে আনন্দানুভূতি তৈরি করে, তার অনেকটা মরমেও পৌঁছে যায়। কাঠবাদামের লালচে পাতাও নিজেকে মেলে ধরেছে অনুপম নান্দনিকতায়। কিংবা সব পাতা ঝরিয়ে কুসুমগাছগুলো বৃক্ষতলে যে রঙিন চাদর বিছিয়েছে তার কি তুলনা হয়?
এই সময়ে পাতার ফাঁকে ফুটে আছে নাগেশ্বরের ফুল। দুধ সাদা পাপড়ির মাঝখানে এর সোনালি রঙের পরাগকেশরগুচ্ছ বেশ মনোমুগ্ধকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কার্জন হল চত্বর, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ অনেক বাগান, পথপ্রাঙ্গণজুড়ে নজর কাড়ে নাগেশ্বরের পাতা-ফুলের বর্ণিলতা। লতানো গাছে সাদা পাপড়িতে মুখ তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে বিউমন্টিয়া। ঘন পাতার মাঝে ওপরের দিকে মুখ লুকিয়ে ফুটেছে অপূর্ব সুন্দর ফুল গুস্তাভিয়া।
কোকিলের কুহু সুরে প্রকৃতির এসব উজ্জ্বল দিনে ফুলে ফুলে গোলাপি হয়ে উঠেছে গ্লিরিসিডিয়া। গাছের নিচে ঝরা পাপড়ির নান্দনিকতায় রেখে যাচ্ছে ফুল ফোটানোর স্মৃতি। শীতের নীরবতা ভেঙে পাতার নিবিড় কোলজুড়ে ফুটছে নীলমনিলতা। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানসহ অনেকের ব্যক্তিগত বাগানে নীলের শোভা দেখা যাচ্ছে। রবি ঠাকুরের ভাষায়, ‘নিবিড় নির্মল নীলে; আনন্দের সেই নীল দ্যুতি/নীলমণিমঞ্জরির পুঞ্জে পুঞ্জে প্রকাশে আকুতি’। ওদিকে ডালে ডালে লালের আভা ছড়াচ্ছে শিমুল ও পলাশের রং। আকাশ ছুঁতে চাওয়া উচ্চতায় নিজেকে প্রকাশ করছে রুদ্রপলাশের ফুল। ফুল ফোটাতে পিছিয়ে নেই অশোক তরুও। দূর থেকে অশোক গাছ দেখে মনে হয়, যেন সবুজপাতার ফাঁকে ফাঁকে আগুন লেগে গেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্কে দেখা যাচ্ছে এর প্রস্ফুটনের রং।
বসন্ত এলেও এখনো বাগানে রং ছড়িয়ে যাচ্ছে শীতের মৌসুমি ফুলেরা: সিলভিয়া, ডালিয়া, হলিহক, জার্বেরা, ডায়ান্থাস, কসমসের রং-মাধুরী মুগ্ধ করছে প্রকৃতিপ্রেমীদের। সেইসঙ্গে বসন্তের রূপসী ফুলের মিছিলে আরও আছে কনকচাঁপা, মহুয়া আর পাখিফুলের শোভা-সুরভি।
বাংলায় ষড়ঋতুর যে বর্ণবৈচিত্র্য প্রকৃতিতে তা বিপুলভাবে প্রকাশিত হয় বসন্তে। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সিন্ধু-হিন্দোল কবিতায় পাই সেই ছবি: ‘আসে ঋতুরাজ, ওড়ে পাতা জয় ধ্বজা;/হল অশোক শিমুলে বন-পুষ্প রজা।/তার পাংশু চীনাংশুক/হল রাঙা কিংশুক,/ উৎসুক উন্মুখ/ যৌবন তার।’ এই ফাগুনে গাছে গাছে এসেছে আমের মুকুল। সবুজ পাতার মাঝে এর ঊর্ধ্বমুখী পুষ্পমঞ্জরির স্বর্ণালি শোভাও উপেক্ষা করার মতো নয়। ডালভরে সাদা রঙের কুন্দ, মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়ানো লেবুর ফুলও জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে।