আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১৩ এএম
আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিহঙ্গকথা

সোনাদিয়ার বাদাবনের কুঁড়ো বক

সোনাদিয়ার বাদাবনের কুঁড়ো বক

অতি বিরল এক পাখির সন্ধানে বার্ডিংবিডি ট্যুরসের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় এসেছি। বেলেকেরদিয়া চরে সেই পাখিটির যখন ছবি তুললাম, তখন ভরা জোয়ার। ধীরে ধীরে জোয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে, জেগে উঠছে চর। সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটে পাখিটির প্রথম ছবি তোলার পর দুপুর ১২টা ১১ মিনিটে শেষ ছবি তুলে ভাটা চলে আসায় আরও কিছু বিরল ও দুর্লভ পাখি দেখার আশায় পাশের কালাদিয়া চরে গেলাম। দুপুর ১টা ৭ মিনিটে কাদাময় চরে নেমে হেঁটে হেঁটে পাখি খুঁজতে লাগলাম। বিকেল ৪টা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় টানা তিন ঘণ্টা প্রচণ্ড রোদে চরের কাদামাটিতে পাখির ছবি তুলে স্পিডবোটে উঠলাম। কিন্তু ভাটা শেষ না হওয়ায় বোটেই কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ফিরতি পথের খালের পানি ভাটায় শুকিয়ে গেছে। খালে পানি এসে বোট চলার উপযোগী হতে নাকি আরও ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগবে। খুবই দুশ্চিন্তায় পড়লাম। কারণ, রাত ৮টায় কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফেরার বাস। দ্রুত জোয়ার না লাগলে তো গাড়ি মিস করব।

আমাদের সমস্যার কথা বিবেচনা করে মাঝি বিকল্প পথ ধরলেন। তাতেও তেমন একটা লাভ হলো না। প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা উপকূলীয় বাদাবনের নাম না জানা এক খালে আমাদের স্পিডবোট হাওয়ায় ভেসে বেড়াল। অত্যন্ত ধীরগতিতে জোয়ার আসছে। ইঞ্জিন চালু করার মতো পানি না আসায় আমরা বাতাসের ওপর ভরসা করে কচ্ছপের গতিতে সামনে এগোতে থাকলাম। ভাগ্য ভালো যে, এখানে মোটামুটি মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে। তাই বাসের কাউন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাসের সময় বদলে রাত ১১টা করতে পারলাম। এর আগে যতবারই সোনাদিয়া এসেছি, এমন অবস্থায় কখনো পড়িনি। যাক বাতাসের তোড়ে আমাদের বোট ধীরে ধীরে সামনে এগোচ্ছে। দুপাশের বাদাবনে ও খালে টুকটাক পাখিও দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই একটি ছোট সাদা বকের সঙ্গে দেখা। এরপর একে একে সবুজাভ মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা, মাথাকালো মাছরাঙা, ছোট টিটি জিরিয়া, লেজ নাচুনে, ছোট সহেলি, কালোমাথা কাস্তেচরা, বড় গোতরা ইত্যাদির দেখা পেলাম। ওদের ছবি তুলতে তুলতে এক সময় আলো কমে এলো।

আলো-আঁধারির খেলায় হঠাৎই খালপাড়ের কাদা থেকে কিছু একটা দৌড়ে বাদাবনের ঝোপের দিকে চলে গেলে। পেছন থেকে ওর কটা ছবি তুললাম। পাখিটি চিনতে মোটেও কষ্ট হলো না। এরপর কিছুটা থিতু ও নিরাপদ মনে হওয়ায় পাখিটি আবারও খালপাড়ে খাদ্যের সন্ধানে এলো। আর অমরাও আলো-আঁধারিতে ওর সাক্ষী ছবি তুলে নিলাম। খানিক পরে জোয়ারের পানি বাড়তে থাকায় মাঝি স্পিডবোটের ইঞ্জিন চালু করল।

এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে এদেশের বক পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য কুঁড়ো বক। ছোট বক, খুদে বক বা সবুজ বক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Striated Heron, Mangrove Heron, Little Heron বা Green-backed Heron। Ardeidae (আরডেইডি) গোত্রের বকটির বৈজ্ঞানিক নাম Butorides striata। এটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি এবং দেশের সর্বত্র বিস্তৃত হলেও অঞ্চলভেদে কোথাও সহজেই চোখে পড়ে, আবার কোথাও বেশ বিরল। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনেও দেখা যায়।

চঞ্চুর আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত কুঁড়ো বক দৈর্ঘ্যে ৪০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৯৩ থেকে ২৩৫ গ্রাম। দেহের রং একনজরে নীলচে সবুজ। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের পালক নীলচে সবুজ, যার পাড় সাদা। মাথার চাঁদির চকচকে কালচে সবুজ ঝুটিটি পেছনের দিকে ঝুলে থাকে। মাথা ও ঘাড় ধূসর। গাল সাদা। একটি কালো রেখা ঠোঁটের গোড়া থেকে চোখের পেছনে চলে গেছে। চোখ উজ্জ্বল লেবু-হলুদ, চোখের পাতা সবুজ। পা ও পায়ের পাতা কালচে সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়ষ্ক বকের দেহের নিচটায় কালচে-বাদামি লম্বালম্বি দাগ। মাথা ধূসর বাদামি। কাঁধ-ঢাকনিতে লম্বালম্বি পীতাভ দাগ ও ডানার পালক ডাকনিতে সাদা ফোঁটা।

কুঁড়ো বক নোনাজলের সুন্দরবন, উপকূলীয় এলাকা, পাথুরে উপকূল, জলাভূমি, খাল, জলাশয়, নদী ও মোহনায় সচরাচর একা একা বিচরণ করে। ভোর ও গোধূলি এবং মেঘলা দিনে বেশি সক্রিয় থাকে। অগভীর পানির সামান্য ওপরে গাছের আড়ালে চুপচাপ পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সুচালো ঠোঁটের আঘাতে শিকার করে। ছোট মাছ, চিংড়ি বা এজাতীয় প্রাণী, ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় ইত্যাদি খায়। ভয় পেলে তীক্ষ্ণ গলায় বারবার ‘কে-ইয়েক কে-ইয়েক’ স্বরে ডাকে।

মার্চ থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় পুরুষ কুঁড়ো বক ঝুটি খাড়া করে, ঘাড় ফুলিয়ে, লেজ দুলিয়ে স্ত্রী বককে ঘিরে দৌড়িয়ে তার প্রেম প্রকাশ করে। নদী ও পুকুরের ধারে ছোট গাছ বা ঝোপঝাড়ে পানির ওপর ঝুলে থাকা ডালে পানি থেকে এক মিটার উচ্চতায় ডালপালা ও কাটিকুটি দিয়ে মাচার মতো বাসা বানায়। স্ত্রী তিন থেকে পাঁচটি ফ্যাকাশে সবুজাভ-নীল ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই ডিমে তা দিয়ে ২১ থেকে ২২ দিনে বাচ্চা ফোটায়। মা-বাবা দুজনে মিলেমিশে বাচ্চাদের খাওয়ায়। এরা দ্রুত বাড়ে; এক সপ্তাহে গাছের ডালে হাঁটাহাঁটি করে, দুই সপ্তাহে উড়তে শেখে ও বাসা ছাড়ে।

লেখক: পাখি, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জুলাই সনদে মিত্রদের ‘কাছাকাছি মতামত’ দেওয়ার পরামর্শ বিএনপির

সন্তানকে বাঁচিয়ে প্রাণ দিলেন বাবা

সৈকতে ফের ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

ইঞ্জিন সংকটে ‘নাজুক’ রেল অপারেশন

স্পেনে রিয়ালের আর্জেন্টাইন তারকাকে নিয়ে অদ্ভুত বিতর্ক

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেন আবু তাহের

মানবিক ড্রাইভার গড়তে নারায়ণগঞ্জে ডিসির যুগান্তকারী উদ্যোগ

গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় জাতীয় পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত

পিএসসি সদস্য হলেন অধ্যাপক শাহীন চৌধুরী

রিয়ালের হয়ে ইতিহাস গড়লেন আর্জেন্টিনার ‘মাস্তান’

১০

দাম্পত্য কলহ এড়ানোর সহজ ৫ উপায়

১১

‘গণতন্ত্রের জন্য আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হতে পারে’

১২

আর্থিক খাত নিয়ে খারাপ খবর দিলেন গভর্নর

১৩

পৌরসভার ফাইল নিয়ে দুই কর্মকর্তার হাতাহাতি

১৪

কর্মস্থলে ‘অনুপস্থিত’, এবার পুলিশের ২ এসপি বরখাস্ত

১৫

এশিয়া কাপ দল নিয়ে তোপের মুখে বিসিসিআই

১৬

নারী-শিশুসহ ছয় ভারতীয় নাগরিক আটক

১৭

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার : উপদেষ্টা আসিফ

১৮

পিয়াইন নদীতে অবাধে বালু লুট, হুমকিতে বসতবাড়ি 

১৯

সোনালী ও জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের ফল প্রকাশ

২০
X