প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। গত বছর থেকেই এ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। প্রাথমিকের বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবি সার্ভিস চার্জ পায়। এনসিটিবিকে সার্ভিস চার্জ না দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মাধ্যমে বই ছাপিয়ে সেটি নিজেদের কাছে রাখতে চায় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর শেষ পর্যন্ত সরাসরি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বই ছাপা হলেও সার্ভিস চার্জ কিংবা রয়্যালটির ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি নয় এনসিটিবি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকের বই ছাপানো নিয়ে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এর আগে একাধিকবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বই ছাপার উদ্যোগ নিলেও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয়নি। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এনসিটিবির কাছ থেকে প্রাথমিকের বই ছাপানোর দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি কালবেলায় ‘প্রাথমিকের বই ছাপতে রশি টানাটানি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিকের বই ছাপার দায়িত্ব নিজেরাই নিতে চাওয়ার বিষয়টি জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মো. ফরিদ আহাম্মদ। অবশ্য আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি উপস্থাপন করলেও তাতে সাড়া দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এরপর গত বছরের ১৩ মার্চ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে বিদ্যমান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন, ২০১৮-এর সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধনের কথা বলা হয়। ওই
প্রস্তাবে ২২ মার্চ অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ২৯ মার্চ সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ধারাবাহিকতায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের সভাপতিত্বে গত বছরের ১৩ আগস্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি থাকায় এনসিটিবি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এরপর গত ৬ নভেম্বর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সভাপতিত্বে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জানানো হয়, আইনটির সংশোধনী খসড়া জনপ্রশাসনে প্রমিতকরণের জন্য পাঠানো হয়েছে। খসড়া প্রস্তাবটির ওপর আরও একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে চূড়ান্ত করতে বলা হয়। আইনটি সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত এনসিটিবির মাধ্যমেই প্রাথমিকের বইসহ সব পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কথা বলা হয়। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে সেটি পিছিয়ে যায়। নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠনের পর সম্প্রতি আবারও বিষয়টি সামনে আনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ফের উপস্থাপন করা হলে তাতে সায় দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, গত ২১ মার্চ সচিবালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, এনসিটিবির কাজ শিক্ষাক্রম তৈরি ও পর্যালোচনা করা। বই ছাপানোর কাজটি প্রশাসনিক। প্রাথমিকের প্রতিটি বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবিকে ২ টাকা ৬০ পয়সা করে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। সে হিসাবে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ কোটি সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বই ছাপালে এ টাকা সরকারের সাশ্রয় হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত অনুমোদনের পর এটি কোর কমিটিতে যাবে। এরপর সংশ্লিষ্ট সব কমিটিতে আলোচনা হবে। তারপর খসড়া হবে। এরপর আইন সংশোধনের জন্য মন্ত্রিসভায় যাবে। এখনো অনেক কাজ বাকি। তবে, এনসিটিবি মানেই যেহেতু শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তারা কালক্ষেপণ করতে পারে। কারণ এত বড় কাজ তারা হাতছাড়া করতে চাইবে না। কালক্ষেপণ করে এনসিটিবি প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি ভিন্নভাবেও বুঝাতে পারে। আবার হঠাৎ করেই বই ছাপানোর দায়িত্ব পেয়ে গেলেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কারিকুলাম করা ও বই ছাপানোর মতো সক্ষমতা রয়েছে কি না, তাও দেখতে হবে।
অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিকের বই ছাপানোর দায়িত্ব নিজেদের অধীনে রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছে। আইনি জটিলতা ও এনসিটিবির আর্থিক সংকটে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে তারা বই ছাপার কাজ নিজেদের অধীনে রাখতে মরিয়া। এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলছেন, জটিলতা কাটাতেই বই ছাপানোর কাজ এনসিটিবির অধীনে এক ছাতার নিচে আনা হয়। এ দায়িত্ব এখন প্রাথমিক অধিদপ্তরে গেলে নতুন করে নানা জটিলতা সামনে আসবে। একই সঙ্গে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে এনসিটিবি।
নেপথ্যে সার্ভিস চার্জ: দেশে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। প্রতি বছর প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি পাঠ্যবই ছাপা হয়। গত ১৩ বছর ধরে ৯৮ লটে ৩০-৩২টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, বই ছাপা ঘিরে নানা সিন্ডিকেট কাজ করছে। এ জন্য বইয়ের মুদ্রণ ও কাগজের মান নিয়ে প্রতি বছর প্রশ্ন উঠছে। তাই বইয়ের মান ভালো করতে ও সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপাতে চায় এই মন্ত্রণালয়।
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যের বই ছাপানোর বরাদ্দ আসে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুকূলে। বর্তমানে যে আইন রয়েছে, তাতে বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবিকে অতিরিক্ত ২ শতাংশ অর্থ সার্ভিস চার্জ হিসেবে দিতে হয়। এতে এনসিটিবির প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা আয় হয়। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘বই ছাপানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। এজন্য এনসিটিবির আইন সংশোধন করতে হবে। এরপর সরকার যা সিদ্ধান্ত জানাবে তাই হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা অনুমতি পেলেই কাজ শুরু করে দেব। এটি নিয়ে কারও সমালোচনার কিছু নেই।’
অন্যদিকে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকের বই সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ছাপালে এনসিটিবির প্রাথমিক শাখার কর্মকর্তাদের খরচও তাদেরই দিতে হবে। কারণ সরকার তাদের বেতন দেয় না। ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ (রয়্যালটি) থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই এনসিটিবির প্রাথমিক শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়।
এনসিটিবির প্রাথমিক শাখার একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় সরকারের ২৫-৩০ কোটি টাকা বাঁচানোর কথা বললেও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। কারণ বই ছাপার সার্ভিস চার্জ না পেলে এনসিটিবির প্রাথমিক শাখার কর্মকর্তাদের বেতনের টাকা সরকারের অন্য খাত থেকে দিতে হবে। তাহলে কার টাকা বাঁচিয়ে তারা কাকে দেবেন?’
বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য এনসিটিবির পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দেওয়ার চিন্তা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সবাই সরকারেরই লোক। সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই আমাদের কাজ। সরকার যদি প্রাথমিকের বই ছাপানোর দায়িত্ব মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে দেয়, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে রয়্যালটি ফি (সার্ভিস চার্জ) এনসিটিবিকে দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানোর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি না করে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছেন। এর মাধ্যমে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। তিনি একতরফাভাবে বলে যাচ্ছেন, তারা বই ছাপালে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা সরকারের লাভ হবে। এনসিটিবির প্রাথমিক শাখার ২৫-২৬ জন কর্মকর্তার বেতন-ভাতা হয় সরকারের দেওয়া রয়্যালটি থেকে। কিন্তু এখন বই নিয়ে যাবে একজন, কারিকুলাম করবে আরেকজন। এটি সমস্যার সৃষ্টি করবে। তারা কাজের দায়িত্ব পেলেও বইয়ের রয়্যালটি দিয়ে যেতে হবে।’