১৯ এপ্রিল, ২০২৩। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বোনের জন্য ইফতারি কিনে বাসায় ফিরছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম। পথে তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জনসমক্ষে ঘটে যাওয়া এ হত্যাকাণ্ড সবার হৃদয়ে নাড়া দেয়।
প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ও আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক জনপ্রতিনিধি। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী দলবল নিয়ে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেন পৌর কৃষক লীগের নেতা (বর্তমানে বহিষ্কৃত) মাসবাউল হক টুটুল। এ বিষয়ে আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি থাকলেও
এখন পর্যন্ত আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়নি পুলিশ। একাধিকবার হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন। প্রধান অভিযুক্তসহ অধিকাংশ আসামি জামিনে বের হয়ে আসায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ভুক্তভোগী পরিবার। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় বিচার নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
জেম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বেশ কয়েকজন। ১৬৪ ধারার এমন পাঁচটি জবানবন্দি এসেছে কালবেলার হাতে। সবগুলোতেই আসামিরা নিজের দায় স্বীকারের পাশাপাশি মূল নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করেন। কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেওয়া পৌর কৃষক লীগের তৎকালীন সহসভাপতি এবং জেম হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামি মাসবাউল হক টুটুল হত্যার দায় স্বীকার করে বলেছেন, ‘গত ৫/১১/২০২২ তারিখে জেলা কৃষক লীগের সম্মেলন নিয়ে জেমের সঙ্গে আমার গ্যাঞ্জাম শুরু। জেলা কৃষক লীগের সম্মেলনে জেম এমপির পক্ষে আর আমি আরেকজন জনপ্রতিনিধির পক্ষে অবস্থান নিই। সম্মেলন-পরবর্তী বিষয়টি নিয়ে ওই জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আমাদের একাধিক বৈঠক হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় জেমকে পঙ্গু করে ফেলার। আমরা কয়েকদিন টার্গেট করেছি; কিন্তু মিস হয়ে গেছে। গত ১৯/৪/২০২৩ তারিখে ইব্রাহীমকে জেমের পিছু নেওয়ার কথা বলি। ইব্রাহীম মাঝে মাঝে জেমের অবস্থান আমাকে জানিয়ে দেয়। বিকেল আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট থেকে ৬ ঘটিকার সময় জেম শাহজাহান হোটেল থেকে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি, রানা, শামীম ও ইব্রাহীম জেমকে ঘিরে ধরি। তারপর আমি সবার প্রথম হাতুড়ি দিয়ে জেমের মাথার পেছনে আঘাত করি। রানাও জেমকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। ইব্রাহীম জেমের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চাকু দিয়ে আঘাত করে। শামীম আমার হাত থেকে হাতুড়ি নিয়ে জেমের পায়ে আঘাত করে। জেম মাটিতে পড়ে যায় আর আমরা পাশের গলি দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যাই। আমরা প্রথমে কাজীপাড়া যাই, সেখান থেকে আমি ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীকে ফোন করে জেমকে মারার ঘটনা বলি। তিনি আমাদের কোনো চিন্তা করতে বারণ করে আপাতত ধীরে কোথাও চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।’
জেম হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৪ নম্বর আসামি মো. ইব্রাহীম জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘গত ৫ নভেম্বর ২০২২ জেলা কৃষক লীগের সম্মেলন থেকে জেমের ওপর আমাদের টার্গেট হয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা একজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করি। আমরা সবাই মিলিত হই এবং সিদ্ধান্ত নিই জেমকে আমরা মারব। তারপর গত ১৯/০৪/২০২৩ইং তারিখে আমি জেমের পিছু নিই এবং সারাদিন তাকে ফলো করি। বিকেল আনুমানিক ৬ ঘটিকার সময় জেম ডায়েন মোড়ে অবস্থান করে। বিষয়টি আমি টুটুল ভাইকে জানাই। টুটুল ভাই, রানা, শামীম ও আমি জেমকে হাতুড়ি দিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করি। তারপর রানা চাচা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। শামীম টুটুল ভাইয়ের কাছ থেকে হাতুড়ি নিয়ে জেমকে পায়ে আঘাত করে। আমি চাকু দিয়ে জেমকে পাঁচ-ছয়টি আঘাত করি।’
মামলার এজাহারভুক্ত ৬ নম্বর আসামি মো. শামীম রেজা তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘টুটুল ভাইয়ের নির্দেশে আমার দোকান থেকে হাতুড়ি নিয়ে সকাল ১১টার দিকে উদয়ন মোড়ে আসি এবং খোঁজ নিচ্ছিলাম কখন জেম আসবে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে টুটুল ভাই, রানা ও ইব্রাহীমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হচ্ছিল। ইফতারের কিছুক্ষণ আগে বিকেল আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিটের সময় টুটুল ভাই আমাকে ফোন করে বলে জেমকে পেয়েছি, তাড়াতাড়ি উদয়ন মোড়ে চলে আয়। আমি উদয়ন মোড়ে গেলে টুটুল ভাই আমার হাত থেকে হাতুড়ি নিয়ে জেমের মাথার পেছনে আঘাত করে। জেম মাটিতে পড়ে যায়। তারপর রানা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। আমি টুটুল ভাইয়ের হাত থেকে হাতুড়ি নিয়ে জেমের পায়ে আঘাত করি। অর ইব্রাহীম চাকু দিয়ে পরস্পর তিন-চারটি আঘাত করে।’
এ ছাড়া এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি মো. মাসুদ রানা ও এজাহারভুক্ত ৯ নম্বর আসামি মো. মিলন হোসেনও জবানবন্দিতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেছে।
জানতে চাইলে জেম হত্যা মামলার বাদী ও জেমের বড় ভাই মো. মনিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আসামিদের বেশিরভাগই জামিনে বের হয়ে আমাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র দিচ্ছে না। আমরা সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। সেইসঙ্গে অধিকাংশ আসামি বাইরে থাকায় আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওদুদ কালবেলাকে বলেন, ‘জেমকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো। কিন্তু পুলিশ এখনো মামলার চার্জশিট দিচ্ছে না। আমি দ্রুত মামলার বিচার চাই। আমাদের ছেলেদের হত্যারই যদি বিচার না পাই, তাহলে এই রাজনীতি করার কী দরকার।’
জানতে চাইলে মামলার সদ্য সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাকসুদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আমি মামলাটির তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা। এর আগে আরও দুজন কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন। আমি মামলাটি নিয়ে চার-পাঁচ মাসের মতো কাজ করেছি। ঈদের আগে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব সিআইডিকে দেওয়া হয়েছে। এখন তারা তদন্ত করছে। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি হত্যা মামলা। এ মামলার কার্যক্রম নিয়ে কোনো কথাই বলা যাবে না।
পরে মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিআইডির পরিদর্শক আব্দুল হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘মামলাটি আমরা বুঝেই পেয়েছি ছয়-সাত দিন হলো। আমরা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি মাত্র।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার ছাইদুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘মামলাটি এখন সিআইডির কাছে আছে। তারা তদন্ত করছে। আপনারা তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’