শেয়ারের দাম কমার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়েও পুঁজিবাজারে পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নিয়ম করেছে, এক দিনে কোনো শেয়ারের দর ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর লেনদেনের প্রথম ঘণ্টায়ই ১০০ পয়েন্ট হারায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক। শেষ পর্যন্ত আগের দিনের তুলনায় এই সূচক ৬০ পয়েন্ট নিচে নামার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সপ্তাহের লেনদেন। সারা দিনে লেনদেন হওয়া ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের মধ্যে দাম কমেছে ৩০০টির। বিএসইসির বেঁধে দেওয়া সীমা অনুযায়ী ৩ শতাংশ কমেছে বেশিরভাগ শেয়ারের দর।
সাধারণভাবে বিএসইসির নিয়ম হচ্ছে, কোনো শেয়ারের দর এক দিনে ১০ শতাংশের বেশি বাড়তে বা কমতে পারবে না। এখন দরবৃদ্ধির এই সীমা ঠিক থাকলেও কমার ক্ষেত্রে এই হার ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কমিশনের এই সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের জন্য আরেকটি ভুল পদক্ষেপ মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধির পরিবর্তে আতঙ্ক বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। কৃত্রিমভাবে পতন থামানোর পরিবর্তে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য কার্যকর প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
এর আগে কৃত্রিমভাবে বাজার ধরে রাখতে শেয়ারের দরপতনের সর্বনিম্ন সীমা বা ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিল বিএসইসি। দীর্ঘ দেড় বছর কার্যকর থাকার পর চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি সেটি প্রত্যাহার করা হয়। ফ্লোরমুক্ত বাজারের শুরুতে দরপতন দেখা গেলেও কয়েকদিনের মধ্যে সূচকের সঙ্গে লেনদেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। তবে ফেব্রুয়ারির শেষদিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শ্রেণি (ক্যাটাগরি) পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে বাজারে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়। ধারাবাহিক পতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ফের ফ্লোর প্রাইস আরোপের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এ ছাড়া একই সময়ে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার বাড়তে থাকে। ফলে শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ে, যা দরপতনকে আরও প্রভাবিত করে।
অবশ্য বিএসইসির দাবি, একশ্রেণির বিনিয়োগকারী বা চক্র বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ তৈরি করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখেনি বিনিয়োগকারীরা। এ ছাড়া বাজার পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে পুঁজিবাজারের অংশীজন ও শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউস প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েকদিন পরপর সভায় বসছে বিএসইসি। তাতেও কোনো কার্যকর ফল না আসায় সর্বশেষ গত বুধবার কমিশন শেয়ারের দরপতন সীমা ৩ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয়।
বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমিশনের নতুন শর্ত কার্যকর হওয়ার দিন শেয়ারের দরপতনের ব্যাপকতা দেখে তারা আতঙ্কিত। নতুন নিয়মের কারণে বাজারে আরও বেশি দরপতন হয়েছে বলে তাদের মত।
বিনিয়োগকারীরা জানান, দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইস কার্যকর থাকায় অনেকের পুঁজি আটকা পড়ে। ফ্লোরে থাকার কারণে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদরের মূল্য সমন্বয় হয়নি। এখন যখন সমন্বয় হচ্ছে, তখন কমিশন আবার শর্ত আরোপ করে নতুন আতঙ্ক তৈরি করছে। অনেকে আতঙ্কিত হয়ে লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছেন। ফলে পতনসীমার সিদ্ধান্তে বাজারে আরও বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
কে কী বলছেন:
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে কমিশন আমাদের সঙ্গে যে সভা করেছে, সেখানে এমন কোনো বিষয়ে (সার্কিট ব্রেকার) আলোচনা হয়নি। এরপরও কমিশন যেটি ভালো মনে করেছে, সেভাবেই পদক্ষেপ নিয়েছে। বাজারের চিত্র দেখে বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নেয়নি। আমরা সব সময় বলে এসেছি, বাজারকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। সেখানে কোনো অনিয়ম বা কারসাজি থাকলে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।’
শীর্ষ ব্রোকার হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরামের সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘পতনমুখী শেয়ারবাজারে অনেকের মধ্যে ফ্লোর প্রাইস আতঙ্ক কাজ করছে। কমিশন দর কমার ক্ষেত্রে নতুন যে শর্ত দিয়েছে, তার সঙ্গে ফ্লোর প্রাইসের সম্পর্ক নেই। এর মাধ্যমে কমিশন বিক্রির চাপ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তারপরও বৃহস্পতিবার লেনদেনের শুরুতেই বড় চাপ ছিল, শেষ পর্যন্ত কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সহজে লাভ করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ কিছুটা সময় নিয়ে বিনিয়োগ করলে আতঙ্কের কোনো কারণ থাকবে না।’
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, ‘বাজার ইতোমধ্যে অনেক বেশি পতন হয়েছে। এখন যে পর্যায়ে এসেছে, সেখান থেকে যৌক্তিকভাবে আরও পতন হওয়ার কারণ দেখি না। এখন যেটি হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক থেকে হচ্ছে। আমার মনে হয়, এ আতঙ্কটা বন্ধ করার জন্যই নিয়ন্ত্রককে ৩ শতাংশের পতনসীমা আরোপ করতে হয়েছে। হয়তো তাদের চিন্তা ছিল, ফলে পতনটা কমে আসবে এবং আস্থাটা ফিরে আসবে; কিন্তু মনে হচ্ছে, এটা কোনো কাজে আসেনিই। এর কারণ আতঙ্ক বন্ধ হয়নি, বরং মানুষ ভাবছে, বাজার বোধ হয় আরও পড়বে, এ জন্যই শর্ত দেওয়া হয়েছে। ফলে বিক্রির চাপটা আরও বেড়ে গেছে।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সুদের হারসহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচক বিবেচনায় শেয়ারবাজার যেখানে যাওয়া দরকার সেখানে যাবেই। ধরে, বেঁধে রাখা যাবে না। ফলে শেয়ারবাজারে দর কমার সীমা আরোপ করার কোনো দরকার ছিল না । সূচক ঠিক করা নিয়ন্ত্রকের কাজ নয়। তাদের কাজ হচ্ছে, সুশাসন নিশ্চিত করা। বাজারে যাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে চলে, সেদিকে খেয়াল রাখা। এই মহূর্তে ভালো কাজ হতে পারতো, বাজেট সামনে রেখে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে বাজারের জন্য কিছু প্রণোদনা নেওয়া। সেটা হলে সার্বিকভাবে পুঁজিবাজার উপকৃত হতো।’