ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা আজ সোমবার মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে। আগামী বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ১০৯টি উপজেলায় বিরতিহীনভাবে চলবে ভোট গ্রহণ। কিন্তু শেষ মুহূর্তের প্রচারে বাগড়া দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। বিশেষ করে উপকূলীয় উপজেলাগুলোর নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এ ঘূর্ণিঝড়। এসব এলাকার প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা প্রচার-প্রচারণা স্থগিত রেখে মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এর মধ্যেও কেউ কেউ আবার দুর্গত মানুষের পাশে থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই প্রচারণার বড় সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। অবশ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোর নির্বাচন স্থগিত করা হবে কি না—ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখে পরবর্তী সময়ে সেই সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, গত ৮ মে প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন শুরু হয়। ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে ভোট গ্রহণ হয় ১৫৬ উপজেলায়। তৃতীয় ধাপে আগামী বুধবার ১০৯টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে উপকূলীয়
জেলা বাগেরহাটের তিনটি, খুলনার তিনটি, সাতক্ষীরার দুটি, বরিশালের তিনটি, পটুয়াখালীর তিনটি, পিরোজপুরের একটি, ভোলার দুটি, ঝালকাঠির দুটি, বরগুনার দুটি, চাঁদপুরের দুটি, ফেনীর তিনটি, নোয়াখালীর তিনটি, লক্ষ্মীপুরের একটি, চট্টগ্রামের চারটি ও কক্সবাজারের তিনটি উপজেলা রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত ১৩ মে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রচারে নামেন উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। ভোটের ঠিক আগ মুহূর্তে জমে উঠেছিল সেই প্রচার। নানা ধরনের আশ্বাস দিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছিলেন প্রার্থীরা। নিয়ম অনুযায়ী, আজ (সোমবার) মধ্যরাতেই তাদের সেই প্রচার শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকার প্রার্থীদের সেই প্রচার এক দিন আগেই থেমে গেছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উপকূলীয় এসব জেলার মানুষকে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে প্রশাসনের তরফ থেকে। আতঙ্কিত অনেক মানুষ গতকাল দিনভর তাদের গুরুত্বপূর্ণ মালপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। ফলে অনেক এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালানোর মতো লোকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভোট চেয়ে ভোটারদের বিব্রত করতে চাননি অনেকে। ফলে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে নিজেদের নির্বাচনী প্রচার ভুলে গিয়ে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা দুর্গত এলাকার মানুষকে ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে সচেতন করতে নানা কার্যক্রমে অংশ নেন। এ সময় অনেক প্রার্থীর প্রচার মাইক থেকে লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগকে অনেকেই আবার ‘সুযোগ’ হিসেবে কাজে লাগানোর কৌশল নেন। নানাভাবে দুর্গত মানুষের পাশে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন তারা। যাতে দুঃসময়ের ভোটে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে সাইদুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে চট্টগ্রামের চার উপজেলা নির্বাচনের প্রচারেও প্রভাব পড়েছে। আগে থেকেই প্রচার কর্মসূচি থাকলেও উপকূলীয় এলাকার আনোয়ারা, চন্দনাইশে কিছুটা পরিবর্তন করে প্রচার বন্ধ করেছেন প্রার্থীরা। একইভাবে বোয়ালখালী ও পটিয়াতে সকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা প্রচার বন্ধ রেখে আবারও বিকেল থেকে প্রচার শুরু করেছেন প্রার্থীরা। যেসব এলাকায় প্রার্থীরা প্রচার বন্ধ করেছিলেন, সেখানে স্থানীয় ভোটার ও সাধারণ মানুষকে নিরাপদে আশ্রয় নিতে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রার্থীদের সমর্থকরাও মাইকিং করছেন। সেইসঙ্গে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তর করতে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও মোবাইল ফোনসহ নানাভাবে ভোটারদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। কেউ কেউ সচেতনতা সৃষ্টির জন্য উঠান বৈঠকও করছেন।
বোয়ালখালী প্রতিনিধি জাহিদ হাসান জানান, উপজেলার কয়েকজন প্রার্থী ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে কিছু সময় প্রচার বন্ধ রাখলেও বিকেলের দিকে আবারও শুরু করেন প্রচার।
চন্দনাইশ প্রতিনিধি খালেদ রায়হান জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও প্রচার বন্ধ রেখে যে যার মতো করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। লোকজনকে নিরাপদে কীভাবে রাখা যায়, সে বিষয়ে প্রশাসনের পাশাপাশি মাঠে রয়েছেন তারা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা বেগম জানান, ‘দুপুর থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। রিমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে, আশ্রয়ণকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে, উপজেলা প্রশাসন সার্বিকভাবে কাজ করছে।’
আনোয়ারা প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উপকূলের রায়পুর, বারশত ও জুঁইদণ্ডী ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রোববার দুপুরে ৯ নম্বর সতর্কতাসংকেত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। আনারস প্রতীকের উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘উপকূলীয় রায়পুর ইউনিয়নের গহিরা ৮ নম্বর ওয়ার্ড, বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদ পুর ও বদলপুরা এলাকায় উঠান বৈঠক ও নির্বাচনী প্রচারের শিডিউল ছিল। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও সতর্কবাসংকেতের কারণে প্রচার ও উঠান বৈঠক বাদ দিয়ে উপকূলীয় এলাকার লোকজনের সঙ্গে দেখা করে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছি। ঘূর্ণিঝড় নিষ্ক্রিয় না হওয়া পর্যন্ত প্রচার বাদ দিয়ে মানুষের পাশে থেকে তাদের সহযোগিতা করার ঘোষণা দিয়েছি।’
বরগুনা জেলা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জেলার পাথরঘাটা ও বামনা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীরা সভা-সমাবেশসহ সব প্রচার-প্রচারণা বন্ধ রেখেছেন। তবে প্রচার বন্ধে ইসি থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল হাই আল হাদী।
তজুমদ্দিন (ভোলা) প্রতিনিধি আবদুল মান্নান জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপটে ভোটারদের মন জয় করতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরা প্রচারে নতুন নতুন কৌশল নিয়েছেন।
নোয়াখালী ব্যুরো জানায়, নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে শুরু হওয়া প্রচার-প্রচারণা শেষ মুহূর্তে জমজমাট। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে প্রচার-প্রচারণায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় প্রার্থীদের ভোটারদের কাছে যেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভোটের প্রচারের পরিবর্তে প্রার্থীরা সচেতনতামূলক কার্যক্রমে ব্যস্ত রয়েছেন।