কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নথি জালিয়াতি, সিনিয়র শিক্ষকদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি, সহকর্মী ও কর্মচারীদের সঙ্গে অসদাচরণ, হেনস্তা ও গালমন্দ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি, নিয়োগে হস্তক্ষেপ, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিনি একের পর এক এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে গেলেও তাকে কিছু বলার জো নেই কারও। কারণ, ক্যাম্পাসে জাকির বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের ডান হাত হিসেবে পরিচিত।
চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত নেতাদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন জাকির। এ ঘটনায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তার বিরুদ্ধে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
এর আগে ২০২২ সালে জাকির ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষককে হেনস্তা করেন। একই বছরের জানুয়ারিতে জাকিরের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কক্ষে তালা দেওয়া হয়। তারা তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে অধ্যাপক তাহের দায়িত্ব পালনে অস্বস্তিবোধ প্রকাশ করে পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৪ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুর রহমানকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন জাকির। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিষয়টি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সিন্ডিকেট সভায় উঠে। সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয়, ভবিষ্যতে এ ধরনের বেপরোয়া আচরণ করলে চাকরিচ্যুতিসহ জাকিরের বিরুদ্ধে প্রশাসন যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে।
জানা যায়, জাকির ২০১৩ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর থেকেই তিনি নিজেকে কখনো সাবেক অর্থমন্ত্রীর অনুসারী, কখনো সাবেক রেলমন্ত্রীর অনুসারী, আবার কখনো কুমিল্লা সদর আসনের এমপি হাজি বাহারউদ্দিন বাহারের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। সাবেক উপাচার্য আলী আশরাফের সময়ে প্রভাব খাটিয়ে জাকির তার ভাই বিল্লালকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেন।
জাকিরের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বাণিজ্যে সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টিও ওপেন সিক্রেট ছিল। কাশিপুর টেকনিক্যাল কলেজের নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করেছেন দীর্ঘদিন। পরে বিষয়টি প্রকাশ পেলে তিনি এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হয়েও বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন জাকির। নিজের পাজেরো গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করেন। তিনি কুমিল্লা ক্লাবেরও সদস্য। এই ক্লাবের সদস্য হতে হলে অন্তত ২০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত দাপ্তরিক কাজ না করারও অভিযোগ রয়েছে। অফিস চলাকালীন তিনি টেন্ডার বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে বেড়ান।
জানা যায়, ২০২১ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের অধীনে নাঙ্গলকোট উপজেলার একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পেতে মেসার্স ল্যান্ডমার্ক বিল্ডার্স, মেসার্স এইচ কবির এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে কুবির তিনটি প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা সনদসহ দরপত্র জমা দেয়। যেখানে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ল্যান্ডমার্ক বিল্ডার্স জাকির হোসেনের স্ত্রী এবং এইচ কবির এন্টারপ্রাইজ তার পরিবারের সদস্যদের নামে। প্রকৌশল দপ্তর জানিয়েছে কুবির এসব প্রকল্পের কোনটিই এই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করেনি।
এ ছাড়া তিনি ও তার বড় ভাই এইচ কবীর এন্টারপ্রাইজসহ বেশ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑল্যান্ডমার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ল্যান্ডমার্ক প্যারা-মেডিকেল ইনস্টিটিউট, কুমিল্লা কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, লালমাই পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, কাশিপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ।
শিক্ষক এবং কর্মকর্তারা জানান, জাকিরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিলেও সেসব আমলে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সর্বশেষ কুবি শিক্ষক সমিতি লাগাতার আন্দোলনের কারণে গত ৫ জুন ৯৫তম সিন্ডিকেট সভায় তাকে ওএসডি করা হয়।
জানতে চাইলে জাকির হোসেন বলেন, আপনি আমাকে এ বিষয় প্রশ্ন করতে পারেন না। এ বিষয়ে জানতে হলে আপনি সিন্ডিকেট সদস্যকে ফোন দেন। আমি আপনাকে কিছু বলব না।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, জাকির একাধিকবার শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছেন। এ কারণে সিন্ডিকেট থেকে তাকে সর্বোচ্চ সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ শিক্ষকদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। উপাচার্যকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর তিনি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বারবার এমন ঘটনা ঘটছে। উপাচার্য যদি কার্যকর ব্যবস্থা নিতেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো না। উপাচার্য তদন্ত কমিটি গঠনে যে দীর্ঘসূত্রতা করেছেন, তাতে বোঝা যায় তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই জাকিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং এসবের মদদদাতা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের সঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রশ্ন লিখে পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি। এর মধ্যে উপাচার্যের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা দুবার ফোন ধরে জানান, উপাচার্য মিটিংয়ে রয়েছেন।