আশির দশকে নোয়াখালী থেকে ট্যানারি শ্রমিক বাবার হাত ধরে ঢাকায় এসেছিলেন মনির হোসেন। এরপর রাজধানীর হাজারীবাগে বিভিন্ন ট্যানারিতে কাঁচা চামড়ার ময়লা পরিষ্কার করতেন দৈনিক ২০ টাকা মজুরিতে। সেই মনির এখন ট্যানারির মাফিয়া। কেউ তাকে চেনেন কোম্পানি মনির নামে, কেউ বলেন লেদার মনির। এরই মধ্যে মালিক হয়েছেন চারটি ট্যানারির। এখন লোকজন তাকে চেনেন শিল্পপতি মনির হোসেন নামে। তবে ট্যানারি ব্যবসার আড়ালে রয়েছে তার ভয়ংকর রূপ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, কামরাঙ্গীরচর থেকে হাজারীবাগ হয়ে মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত যেখানেই খালি জমি রয়েছে, সেখানেই তার চোখ। জমি দখলের পাশাপাশি কেউ তা বিক্রি করতে চাইলেও মাধ্যম বানাতে হয় তাকে। এজন্য গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী ক্যাডার বাহিনী। তার মতের
বাইরে গেলে কিংবা তাকে না জানিয়ে জমি বিক্রি করলে নির্যাতন নেমে আসত জমি মালিকের ওপর। খুনের নির্দেশ দিতেও দ্বিধা করেন না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে রয়েছে তার সখ্য। তার চেয়েও প্রভাবশালীদের নানা উপহার-উপঢৌকন দিয়ে সবসময় থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশ্য নানা কৌশল করেও শেষ রক্ষা হয়নি এ ট্যানারি মাফিয়ার। নিজের এক সময়ের সহযোগী মো. এখলাসকে খুন করে ফেঁসেছেন তিনি। খুনের নির্দেশ দিয়ে পালিয়ে দেশ ছাড়লেও ফের গোপনে দেশে এসে গ্রেপ্তার হয়েছেন গোয়েন্দাদের হাতে। তাকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গোয়েন্দাদের ধারণা, এ জিজ্ঞাসাবাদে হাজারীবাগ এলাকায় অপরাধের অন্ধকার জগতের চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, ট্যানারিতে ২০ টাকা দৈনিক মজুরির শ্রমিক মনির হোসেন এখন ট্যানারির বড় মাফিয়া। হাজারীবাগ আর সাভারে মালিক হয়েছেন চারটি ট্যানারির। তবে তার মূল বাণিজ্য জমির দালালি। অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্যে ছাড়াও তার নানা অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ মিলেছে। ডিবি জানায়, মূলত এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেই কাঁচা চামড়া বেচাকেনা শুরু করেন কোম্পানি মনির। এরপর নামেন ভূমি দখল ও ভূমির ব্যবসায়। এভাবেই শূন্য থেকে সে হয়ে ওঠেন শিল্পপতি। ২০০২ সালে হাজারীবাগে সিকদার পেট্রোল পাম্পের সামনে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় রুহুল আমিন নামে এক ব্যক্তিকে। ওই হত্যা মামলায় অন্যতম আসামি ছিলেন এই লেদার মনির ওরফে কোম্পানি মনির। ২০১৫ সালে ইফতারির পূর্ব মুহূর্তে জসিম ওরফে গুন্ডা জসিম নামে একজনকে হাজারীবাগ বাজারের মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই খুনেরও নির্দেশদাতা ছিলেন মনির। তবে প্রভাবশালীদের তদবির এবং ব্যবসায়ী মুখোশের কারণে ওই সময় ছাড়া পেয়ে যান। ডিবির এক সূত্র জানায়, মনির কাউকে খুনের বা নির্যাতনের নির্দেশ দিলেও সে বিষয়ে কেউ টের পেত না। নিজের অপরাধ জগত চালাতেন জঙ্গিদের মতো ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে। সর্বশেষ এখলাসকে হত্যার পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন ওমরাহ পালন করতে। ফিরে এসে হত্যার চূড়ান্ত ছক কষে ফের চলে যান হজ পালনের জন্য। দেশে ফিরলেও গোয়েন্দাদের গতিবিধি বুঝতে পেরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। নানা মাধ্যমে আগের ঘটনার মতো টোপ দেওয়ারও চেষ্টা চালান। তাতে কাজ না হওয়ায় পালিয়ে যান কলকাতায়। সেসময় ঢাকার বিমানবন্দর ব্যবহার না করে চট্টগ্রাম থেকে উড়াল দিয়েছিলেন তিনি। ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান জানান, কলকাতা থেকে গোপনে সীমান্ত পার হয়ে দেশে ফিরে সাম্রাজ্য চালাতে চেয়েছিলেন মনির। সে অনুযায়ী বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশে ফেরেনও; কিন্তু ওই এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দারা। ওই সময়ে তার কাছ থেকে দুটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, একটি মোবাইল ফোন, ২২ হাজার বাংলাদেশি টাকা আর পাঁচ হাজার ভারতীয় রুপি উদ্ধার করা হয়। এই কর্মকর্তা বলেন, মনিরের পাসপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৫ জুলাই সকালে তিনি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে কলকাতায় প্রবেশ করেন; কিন্তু পরে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে দেশে প্রবেশের কোনো তথ্য পাসপোর্টে নেই। কলকাতা থেকে অবৈধ পথে বেনাপোল দিয়ে যশোরে ঢুকে কাজ শেষে আবার একই পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল তার। কী জন্য দেশে এসেছিলেন, রিমান্ডে তা জানার চেষ্টা করা হবে।
মন্তব্য করুন