ব্যাংক ঋণ যথাসময়ে ফেরত না দেওয়ায় খেলাপি ঋণের তালিকা বড় হচ্ছে। এ তালিকায় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো। তারাও যথাসময়ে পরিশোধ করছে না ব্যাংকের পাওনা। ফলে তাদের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনার অঙ্ক বেড়েই চলেছে। লোকসানের কারণে পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। ফলে খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪ পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৩০ সরকারি সংস্থার মধ্যে ১৯টির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের বকেয়া রয়েছে ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। এ অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের ব্যবধানে বকেয়া ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৮৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় সামান্য কম। সেই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ১৮৫ কোটি টাকা।
জানা গেছে, নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় সরকারি সংস্থাগুলোর আর্থিক অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। উল্টো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লোকসানের ঘানি টেনে যাচ্ছে সরকার। ফলে বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান আরও বাড়ছে। এ সময় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিট লোকসান হবে ২৮ হাজার ৪৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন অর্থবছর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান বাড়বে ২২ হাজার ৫৮ কোটি টাকা, যা প্রায় সাড়ে চার গুণ বেশি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সক্ষমতা থাকার পরও লোকসান দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। আর জনগণের করের টাকা দিয়েই এই লোকসানের দায় মেটাচ্ছে সরকার। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের অন্যতম শর্তই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানো।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি পাওনা রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কাছে, বকেয়ার পরিমাণ ১৩ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাওনা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) কাছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) কাছে পাওনা ৮ হাজার ২৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এ ঋণের বড় অংশই নেওয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংক থেকে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে পাওনা ৬ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছে পাওনা ৭ হাজার ৪৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠান বিবিসির কাছে রয়েছে ৪ হাজার ৪৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ খাতের অন্য প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসির কাছে পাওনা ৩৩৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) কাছে ব্যাংকের পাওনা ৬৭২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) কাছে ব্যাংক পাবে ২৫ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে (সিপিএ) পাওনা ১১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (বিওজিএমসি) কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ১২৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর ঢাকা ওয়াসার কাছে ৮১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) কাছে ব্যাংকের পাওনা ৫৬২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) কাছে পাওনা ২২৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) কাছে বকেয়া ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কাছে ১২১ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, এ সময়ে ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে বিজেএমসির কাছে ১৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিএডিসির কাছে ২১ কোটি ২৭ লাখ, বিটিএমসির কাছে ২৪ কোটি ৯ লাখ ও বিটিবির কাছে ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
এদিকে চলতি অর্থবছর ১১টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকসান হয়েছে ১৯ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর সর্বোচ্চ লোকসানে পড়েছে বিপিডিবি। এবার প্রতিষ্ঠানটির নিট লোকসানের অঙ্ক ৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। লোকসানে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় অবস্থান টিসিবির, ৬ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। আর ৪ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে তৃতীয় অবস্থান বিআরইবির। এ ছাড়া বিটিএমসির ১৪ কোটি টাকা, বিএসএফআইসি ৫৭১ কোটি, বিসিআইসি এক হাজার ৫০৯ কোটি, বিআইডব্লিউটিসি ৬০ কোটি, বিআরটিসি ১১৭ কোটি, আরডিএ ৯৭ কোটি, বিএফডিসি ২১ কোটি, বিআইডব্লিউটিএ ১২৬ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে।