সময় বদলেছে, বদলেছে সৌন্দর্যচর্চার সংজ্ঞা। এখন আর নিখুঁত ত্বক শুধু জন্মগত নয়—বরং যত্ন, প্রযুক্তি আর সঠিক চিকিৎসার মেলবন্ধন। ত্বকের যত্নে ‘অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট’ এখন আর তারকাদের গোপন রহস্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যেও জনপ্রিয় এক সৌন্দর্যযাত্রা। বর্তমান সময়ে কোন কোন অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এর কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, স্থায়িত্ব কতদিন থাকবে, এমন নানা দিক জানিয়েছেন—ডা. ফাতিহা খুলদ মিয়ামি
অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট আসলে এমন এক ধরনের চিকিৎসা বা থেরাপি, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ত্বকের সৌন্দর্য, মসৃণতা ও তারুণ্য ফিরিয়ে আনা হয়। এতে ব্যবহার হয় লেজার, বোটক্স, ফিলার, মাইক্রোনিডলিং, হাইড্রাফেসিয়াল, স্কিন টাইটেনিং, পিআরপি ইত্যাদি পদ্ধতি, যা সার্জারির বিকল্প হিসেবে নিরাপদ ও কার্যকর। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই কার্যকর। বয়সজনিত বলিরেখা, ব্রণের দাগ, রোদে পোড়া ত্বক, কিংবা ক্লান্ত চেহারায় প্রাণ ফিরিয়ে আনতে চাইলে অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট হতে পারে সেরা সমাধান। তবে ট্রিটমেন্ট শুরুর আগে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।
অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট নানা ধরনের রয়েছে, তবে বর্তমান সময়ে কোন কোন ট্রিটমেন্টগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে? এ প্রসঙ্গে সিডোনা অ্যাসথেটিক ডার্মা ও লেজার সেন্টারের চিকিৎসক ডা. ফাতিহা খুলদ মিয়ামি বলেন, ছেলেমেয়ে উভয়েরই প্রতি মাসে অন্তত একটি করে মেডিকেটেড ফেসিয়াল নেওয়া উচিত যেমন—হায়ড্রা ফেসিয়াল, মেজোথেরাপি বা পিআরপি। তবে এ ক্ষেত্রে বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তা ছাড়া অনেকে জানতেও চায় কোন বয়স থেকে অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্টগুলো শুরু করা উচিত। সে ক্ষেত্রে আমরা বলে থাকি, বয়স যদি ২৫-এর বেশি হয় তাহলেই আমাদের প্রত্যেকের ত্বকের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। অনেকেই আছে যাদের খুব অল্প বয়সেই মেসতা বা বলিরেখা পড়ে যায়। এ ধরনের সমস্যাগুলো নিয়ে মানুষ বেশি আসেন। এসব সমস্যার জন্য আমরা শুরুতে কিছু ওষুধ দিয়ে থাকি। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্টও দিয়ে থাকি। ত্বকের প্রয়োজন ও পছন্দ অনুযায়ী আজকাল নানা ধরনের ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো বোটক্স। আমাদের লাইফস্টাইলের কারণে ঘুম কম হয়, অনেক দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ডিভাইস বা টিভির সামনে থাকা হয়। ফলে দেখা যায়, ত্বকে বলিরেখা খুব দ্রুত চলে আসে। এমনও অনেক রোগী আসেন, যাদের অনেক বেশি বলিরেখা দেখা যায়। কিন্তু যখন বয়স জিজ্ঞেস করি, তারা বলেন ২০ কি ২২। ত্বকের বলিরেখা দূর, পেশি শিথিল করতে বোটক্স ট্রিটমেন্ট খুব ভালো। এ ছাড়া আছে ফিলার। অনেকেই আছেন গাল, ঠোঁট বা চিবুকে ভলিউম বাড়াতে চান। সে ক্ষেত্রে আমরা ফিলার করে থাকি। ত্বককে গভীরভাবে পরিষ্কার, হাইড্রেশন ও প্রাকৃতিক গ্লো ফিরিয়ে আনে হাইড্রা ফেসিয়াল। দাগ, পিগমেন্টেশন বা অবাঞ্ছিত লোম দূর করতে কার্যকর লেজার ট্রিটমেন্ট। কেমিক্যাল পিল মৃত কোষ সরিয়ে ত্বকে এনে দেয় নতুন প্রাণ। মাইক্রোনিডলিং কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে ত্বকের টেক্সচার উন্নত করে। পিআরপি বা ‘ভ্যাম্পায়ার ফেসিয়াল’ নিজের রক্তের প্লাজমা ব্যবহার করে ত্বকের পুনর্জীবন ঘটায়।
আজকাল অনেকেই আছেন নিজের ইচ্ছেমতো অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্টগুলো করে থাকেন। তবে যে কোনো ধরনের ট্রিটমেন্টের আগে একজন ভালো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে জানতে হবে নিজের ত্বকের ধরনও। অনেকেই আছেন যাদের ত্বক তৈলাক্ত, আবার কারও শুষ্ক আবার কারও কারও কম্বিনেশন স্ক্রিন (সংবেদনশীল ত্বক)। তাই অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট নেওয়ার আগে ত্বকের ধরনটি জেনে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
কোন ত্বকের জন্য কোন ট্রিটমেন্ট উপযুক্ত? এ প্রসঙ্গে ড. মিয়ামি বলেন, ত্বকের ধরন, বয়স ও সমস্যার ওপর নির্ভর করে সঠিক ট্রিটমেন্ট নির্বাচন করা হয়। তৈলাক্ত ত্বকে কেমিক্যাল পিল বা লেজার ট্রিটমেন্ট ভালো ফল দেয়। শুষ্ক ত্বকে হাইড্রা ফেসিয়াল বা ফিলার উপযুক্ত। সংবেদনশীল ত্বকে পিআরপি বা মাইক্রোনিডলিং তুলনামূলক নিরাপদ। বয়সজনিত সমস্যা সমাধানে দারুণ ভূমিকা পালন করে বোটক্স বা ফিলার। ডার্মাটোলজিস্টরা সাধারণত স্কিন অ্যানালাইসিস মেশিন ও প্যাচ টেস্ট করে ট্রিটমেন্ট নির্ধারণ করেন।
অনেকেই মনে করে থাকেন, বিভিন্ন ধরনের মেশিন ব্যবহারের ফলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। এ বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন ড. মিয়ামি। তিনি বলেন, অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে করালে ঝুঁকি তুলনামূলক কম, তবুও কিছু অস্থায়ী প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে—হালকা ফোলাভাব বা লালচেভাব, সামান্য ব্যথা বা চুলকানি, সংবেদনশীলতা বা ত্বক টানটান লাগা, কিছু ক্ষেত্রে অস্থায়ী ব্রণ। তাই অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট নেওয়ার পর রোদে যাওয়া এড়িয়ে চলুন, সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। ট্রিটমেন্টের এক সপ্তাহ আগে রেটিনল বা অ্যাসিডযুক্ত পণ্য বন্ধ রাখুন। পর্যাপ্ত পানি পান ও ত্বক হাইড্রেট রাখুন। চিকিৎসকের দেওয়া প্রি-ট্রিটমেন্ট নির্দেশনা মানুন।
অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্টের স্থায়িত্ব মূলত নির্ভর করে ট্রিটমেন্টের ধরন, ব্যবহৃত প্রযুক্তি, ত্বকের ধরন ও পরবর্তী যত্নের ওপর। নিচে জনপ্রিয় কিছু ট্রিটমেন্টের আনুমানিক স্থায়িত্ব দেওয়া হলো—বোটক্সের স্থায়িত্ব তিন-ছয় মাস। কার্যকারিতা বাড়াতে নিয়মিত রিফিল এবং সূর্যালোক থেকে সুরক্ষা জরুরি। ডার্মাল ফিলারের স্থায়িত্ব ছয় মাস থেকে দুই বছর (ব্যবহৃত ফিলারের ধরন অনুযায়ী)। কেমিক্যাল পিল স্থায়িত্ব এক থেকে তিন মাস (মাইল্ড পিলের ক্ষেত্রে), গভীর পিলের ক্ষেত্রে ছয় মাস বা তারও বেশি। লেজার ট্রিটমেন্টের স্থায়িত্ব ছয় মাস থেকে স্থায়ী ফলও পাওয়া যায় (ত্বকের সমস্যার ধরন অনুযায়ী)। মাইক্রোনিডলিং স্থায়িত্ব চার থেকে ছয় মাস। ফল দীর্ঘস্থায়ী করতে নিয়মিত সেশন (তিন-ছয়বার) প্রয়োজন। হাইড্রাফেসিয়াল স্থায়িত্ব এক থেকে দুই সপ্তাহ। মনে রাখতে হবে, এ ট্রিটমেন্ট নেওয়া মানে স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট সময় পরপর ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।
অ্যাসথেটিক ট্রিটমেন্ট এখন শুধু চেহারায় পরিবর্তন নয়, বরং মানসিক আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন। তবে যে কোনো চিকিৎসা শুরু করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। কারণ, প্রতিটি ত্বকই আলাদা—তাই সৌন্দর্যের পথও হওয়া উচিত ব্যক্তিগত, নিরাপদ ও সচেতন।
মন্তব্য করুন