অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে নেতিবাচক প্রবণতা নিয়েই শুরু হয় ২০২৪ বছরটি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনীতির প্রতিটি খাতে লুটপাট ও অনিয়মের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেও তা গোপন রাখা হয়। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর বিপদসংকুল অর্থনীতির চিত্র প্রকাশ পায়। পরিস্থিতির উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকিং খাতসহ বেশ কিছু সংস্কার উদ্যোগ নিলেও গত ৫ মাসে অর্থনীতি তেমন কোনো গতি পায়নি। আগের শেখ হাসিনা সরকারের আমলে খাদের কিনারে ফেলে যাওয়া দেশের অর্থনীতিকে এখনো টেনে তুলতে পারছে না ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ অর্থনীতিতে এখনো স্থিতিশীলতা ফেরেনি।
জানা গেছে, ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের দায় রেখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। এরপর ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই থেকে অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কারের ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের চেষ্টাও চলছে। তবে কোনো কিছুতেই অর্থনীতির হারানো তেজ ফেরানো যাচ্ছে না। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িত হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সর্বস্তরের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, মানুষের আশার আলো ফিকে হতে শুরু করেছে।
বিভিন্ন সংস্থার হালনাগাদ তথ্য বলছে, দু-একটি বাদে অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক এখনো নিম্নমুখী। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। নিত্যদিনের যন্ত্রণা হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ঊর্ধ্বমুখী মুল্যস্ফীতি। এটি একদিকে মানুষের সঞ্চয়ের টুঁটি চেপে ধরছে, অন্যদিকে ক্রেতার সক্ষমতায় চিড় ধরিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। এতে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যেও যেমন তৈরি হয়েছে স্থবিরতা, তেমনি সরকারের রাজস্ব আয়েও বিরাট ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আবার সরকারের আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ করার প্রবণতা বাড়ছে, যা কমিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ পরিস্থিতিতেও চলছে ভাটা। আর বিগত সরকারের লুটপাটের সবচেয়ে বড় থাবা পড়েছিল ব্যাংক খাতে। লুটের অধিকাংশ টাকাই দেশ থেকে পাচার করে দিয়েছে। সেই পাচারের অর্থ দেশে ফেরাতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে নতুন সরকার। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের অর্থায়নের প্রধান উৎস হলো রাজস্ব খাত। এখানকার বড় ঘাটতি থেকেই অর্থনীতির সব সমস্যার সূত্রপাত। বিগত সরকারের বড় সমালোচনার জায়গা ছিল রাজস্ব আয়ের ঘাটতি। বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার আগে এই বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন। তবে দায়িত্ব নিয়ে তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সংস্কারের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন দফা বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। এতেও মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা যাচ্ছে না। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা বাস্তবতায় এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটেই ঘোরাফেরা করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বলছে, গত নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপে একদিকে কমছে আমদানি, অন্যদিকে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। ফলে নতুন বিনিয়োগে যেতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও কমে যাচ্ছে। চলতি অক্টোবরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশে, যা গত ৪০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোয় উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা রিবাজ করলেও গত ১৫ দিনে সেখানেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি এবং রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও হঠাৎ করেই ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
হাসিনা সরকারের সময়ে রাজস্ব ঘাটতির বিপরীতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকারের ব্যয় অত্যধিক বেড়েছে। ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিয়েই সেই ঘাটতি পূরণ করেছে সরকার। আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় ঋণ নিয়ে দেশ পরিচালনার দিকেই ঝুঁকছে নতুন সরকার। তবে আশার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেই বেশি ঋণ নিচ্ছে সরকার।
এস আলমমুক্ত ব্যাংকিং খাতও ২০২৪ সালের অন্যতম অর্জন। বিগত সরকারের সময়ে অর্থনীতি ধ্বংসের মূল আয়োজন ছিল ব্যাংকিং খাতে লুটপাট ও অর্থ পাচারকে কেন্দ্র করে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গ্রাহকের আমানতের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া হবে। এজন্য গ্রাহকদের আরও কিছুটা সময় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সংকটে পড়া ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেইসঙ্গে এসব ব্যাংকে প্রয়োজন অনুযায়ী, গ্যারান্টির ভিত্তিতে তারল্য সহায়তাও দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেও এসব ব্যাংকের পরিস্থিতি উত্তরণ হচ্ছে না। একই সঙ্গে বিগত সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অভাব ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতার কারণে ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান খেলাপি ঋণের চিত্র অর্থনীতিতে ভয়ংকর রকমের উদ্বেগ তৈরি করেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। কেবল টাকার অঙ্কে নয়, বেড়েছে শতকরা হিসেবেও। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ সময় খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এই হার দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
নতুন সরকারের সবচেয়ে আশার দিক হচ্ছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এর ফলে রিজার্ভও বর্তমানে স্থিতিশীল রয়েছে। একই সঙ্গে ডলারের বাজারেও গত চার মাস স্থিতিশীল থাকলেও এখন সেখানে আবার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে সাবেক প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে মিলে ব্যাংকিং খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এর মধ্যে এস আলমই পাচার করেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। নজিরবিহীনভাবে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বর্তমান সরকার নানা ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।