বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই নারী শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হয়ে বিশেষত নারীদের রক্তাক্ত হতে দেখে সারা দেশের মানুষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছাত্রীরাই ঢাল হয়ে দাঁড়ান। যখন এ আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তখন দেশের সব শ্রেণি-পেশার নারীদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ দেখা যায়। মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন তারা, রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, প্রশাসনের দমননীতি রুখতে সাহসী অবস্থান নিয়েছিলেন।
তবে অভ্যুত্থানের পর নারীদের উপস্থিতি ক্রমেই কমে আসছে। যারা একসময় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তাদের অনেকে এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা নারীদের এখন সাইবার বুলিং, রাজনৈতিক চাপ ও সামাজিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘জুলাইয়ের নারীরা’ হারিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম, যিনি অভ্যুত্থানে সম্মুখসারির অন্যতম নেত্রী ছিলেন; বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কমে গেছে। নারীদের শুধু সংগ্রামের সময় সামনে আনলেই হবে না, নীতিনির্ধারণেও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা মনে করেন, ‘আমরা নারী-পুরুষের পরিচয় ভুলে পথে নেমেছিলাম, কারণ আমরা দেখেছিলাম রাষ্ট্র কীভাবে তার নাগরিকদের হত্যা করছিল। এখন আমরা দেখি, অভ্যুত্থানের পর নারীরা তাদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে পায়নি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী স্মৃতি আফরোজ সুমি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন কিংবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি সংগ্রামে নারীরা সংগঠক, যোদ্ধা ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু ইতিহাসে তাদের ভূমিকা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। গণঅভ্যুত্থানের সফলতার অন্যতম ভিত্তি ছিল নারীদের অংশগ্রহণ, তাই তাদের যথাযথ স্বীকৃতি ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।’
ঢাবির শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম সাকাফি মনে করেন, নারীদের সূক্ষ্মভাবে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে—‘জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, কিন্তু অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখছি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে নারীদের অনুপস্থিতি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের নেতৃত্ব সহজভাবে নেয় না, বরং তাদের মনোবল ভেঙে দিতে নানা কৌশল গ্রহণ করে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নারীদের উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমছে।’
নারীদের সাহসী ভূমিকার কথা স্মরণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না খান বলেন, ‘নারীরা শুধু মিছিল করেননি, তারা প্রতিবাদ মঞ্চ পরিচালনা করেছেন, সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু প্রশাসন নারীদের ভয় দেখাতে নানা কৌশল নিয়েছে, অনেককে গ্রেপ্তার করেছে, হেনস্তা করেছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সিনথিয়া জাহীন আয়েশা বলেন, ‘প্রচলিতভাবে বলা হয় নারীরা দুর্বল, নারীরা ভয় পায়, তাদের প্রতিরোধের ভাষা নেই। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে আমরা দেখেছি, নারীরাই পুলিশের প্রিজন ভ্যান আটকেছে, পুলিশের হাত থেকে সহযোদ্ধাদের ছিনিয়ে এনেছে, গুলির সামনে মৃত্যুকে বরণ করে এগিয়ে গেছে। অথচ অভ্যুত্থানের পর উপদেষ্টা পরিষদ ও সংস্কার কমিশন থেকে নারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার জায়গায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।’
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী শারমিন উদ্দিন বলেন, ‘নারীরা শুধু সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন না, পরোক্ষভাবেও আন্দোলনে অবদান রেখেছেন। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের জায়গা হয়নি। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রতিটি সেক্টরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।’
ঢাবির শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমু বলেন, ‘নারীরা অভ্যুত্থানের সম্মুখসারিতে ছিলেন, কিন্তু অভ্যুত্থানের পর তাদের উপস্থিতি সীমিত হয়ে গেছে। কোনো জাতীয় নেত্রী তৈরি হয়নি। নারী সংগঠকরা দৃশ্য থেকে হারিয়ে গেছেন। জননিরাপত্তার অভাবে সাহসী নারীরাও ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন।’
ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজ্জহুরা বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ মনে করার চেষ্টা করলেই চোখে ভেসে ওঠে এক মায়ের ছবি, যিনি পানি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন, এক মায়ের দৃশ্য, যিনি সন্তানের মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও হাসিনার পতন চেয়েছিলেন।’
অভ্যুত্থানের সম্মুখসারিতে থাকা নারীদের ভূমিকা আজকের বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর আমরা তাদের হারিয়ে যেতে দেখছি। রাষ্ট্র গঠনের প্রতিটি স্তরে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেই হবে না, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা রাখতে হবে। নারীরা শুধু আন্দোলনের সৈনিক হয়ে থাকলে চলবে না, তাদের নীতিনির্ধারক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নারীদের এ অবমূল্যায়ন থামাতে হলে আমাদের সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। নারী নেতৃত্বের স্বীকৃতি দিতে হবে, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। না হলে আগামী দিনে নারীদের রাজনৈতিক উপস্থিতি আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে। যে নারীরা গুলি-বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে এ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন, তাদের জন্য রাষ্ট্রে মর্যাদার আসন তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
মন্তব্য করুন