যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির ঘোষণায় বৈশ্বিক বাণিজ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও চীনসহ অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেওয়ায় বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত বুধবার বিকেলে হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ৫ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব পণ্যে ১০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হবে। এ ছাড়া আগামী ৯ এপ্রিল থেকে প্রায় ৬০টি দেশের পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক বসানো হবে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের বিদেশি গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপেরও ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এই পদক্ষেপকে বাণিজ্যে অন্য দেশগুলোর ‘অন্যায্য নীতি’র জবাব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার ট্রাম্প উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ মোকাবিলায় ‘দৃঢ় পাল্টা ব্যবস্থা’ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় দাবি করে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বৈধ অধিকার ও স্বার্থ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপের এই সিদ্ধান্তের পরিণতি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য ভয়াবহ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই অনিশ্চয়তা বিশ্বব্যাপী সুরক্ষা বাণিজ্যের প্রবণতা বাড়াবে এবং এর ফলে কোটি কোটি মানুষের জীবন দুর্দশায় পড়বে।’ একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত বলেও জানান তিনি। আর সেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিও যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে এ শুল্ক মোকাবিলা করতে যাচ্ছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে ‘ভুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ বড় আকারে একটি বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিলও ট্রাম্পের পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে দেশটির নির্বাহী বিভাগকে অনুমতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র দক্ষিণ কোরিয়াও বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা করছে। দেশটির পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত আসার পর এক প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সু বলেছেন, ‘বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ এখন বাস্তবতা।’
এদিকে বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের প্রভাব অনুভূত হতে শুরু করেছে। দেশে দেশে পুঁজিবাজারে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে স্বর্ণ ও বন্ডের দিকে ঝুঁকছেন, যা বাড়িয়ে দিয়েছে স্বর্ণের দাম।
বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক নীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক করেছে। বার্কলেস ও বিএফএ গ্লোবাল রিসার্চের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডাব্লিউর অনুমান, ইউরোপীয় অর্থনীতি এই শুল্কের ফলে প্রায় ৭৫০ বিলিয়ন ইউরো ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এই শুল্ক নীতি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব উৎপাদন শিল্পকে উৎসাহিত করবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স স্বীকার করেছেন, এই পদক্ষেপ স্বল্প মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ব্যয় বাড়াবে। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি অনেক আমেরিকান উদ্বিগ্ন, তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এটি রাতারাতি পরিবর্তন হবে না।’
এই শুল্ক নীতির কারণে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক মেরূকরণও নতুন মাত্রা পেয়েছে। কানাডা ও মেক্সিকোর মতো দেশগুলোর সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক জোট গড়ার ইঙ্গিত দিয়ে জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হ্যাবেক বলেন, ‘নতুন বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা আমাদের কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা উচিত।’
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ভোক্তা পর্যায়ে ব্যয় বাড়াবে, যা সামগ্রিকভাবে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকেই মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
মন্তব্য করুন