স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনকে ‘জুলাই আন্দোলন’ বলা হলেও এর সূচনা হয় মূলত গত বছরের ৫ জুন। সেদিন হাইকোর্ট এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোটার পক্ষে রায় দেন। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও সরকারের অনীহা ও পুলিশি দমনপীড়নের কারণে জুলাইয়ে এসে আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ মাসেই প্রাণ ঝরে বহু ছাত্র-জনতার। জন্ম নেয় ইতিহাসের দীর্ঘতম জুলাইয়ের। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট, অর্থাৎ ‘৩৬ জুলাই’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। শেষ হয় দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ আগেই তৈরি হয়ে ছিল। সেটার বহিঃপ্রকাশ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই উপলক্ষই তৈরি হয় জুলাইয়ে। ছাত্রদের শরীরে সরাসরি গুলি করার মাধ্যমে নিজেদের চূড়ান্ত পতন ডেকে আনে শেখ হাসিনা সরকার। ফলে কোটা আন্দোলন থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আগে থেকেই ভুক্তভোগী এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ নিজের জীবনবাজি রেখে স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। আর এটা ছিল অবশ্যম্ভাবী।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের সূচনা ২০১৮ সালে হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তখন চাকরিতে কোটা তুলে দিয়েছিল সরকার। ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে কোটা পুনর্বহাল হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয় নতুন আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে ১ জুলাই থেকে মিছিল-সমাবেশ শুরু করে। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ কেন্দ্র করেই চলছিল শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি। প্রায় প্রতিদিন শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন তারা। ধীরে ধীরে আন্দোলনের পরিসরও বাড়তে থাকে দেশজুড়ে।
তবে বিক্ষোভের অনলে ঘি ঢালেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’-সংক্রান্ত এক বক্তব্য ও শিক্ষার্থীদের দাবিকে আইন-আদালতের চক্করে ফেলার পর তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন—‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে।
১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের দিন ছাত্রলীগকে নামিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে; তারা প্রস্তুত। এর পরই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। দফায় দফায় ছাত্রীদেরও ধরে ধরে পেটানো হয়। গুলি করা হয় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে।
আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে ১৬ জুলাই। সেদিন আবু সাঈদ-ওয়াসিমসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়। এর পরই কোটা আন্দোলন আর এর মধ্যে থমকে রইল না, রূপ নেয় গণআন্দোলনে। সেদিন শিক্ষার্থীরা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সরকারই উদ্ভূত সমস্যার জন্য দায়ী এবং সরকারকেই সমাধান করতে হবে। বিক্ষোভকারীরা ঘোষণা করেন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৯ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। সেই দাবি পূরণের বদলে বেছে নেওয়া হয় নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তারের পুরোনো পথ। বাংলাদেশে যা কখনো হয়নি, তা-ই হলো; বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গুলি করে মারা হলো, কলেজ শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, স্কুলশিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো। মায়েরা কাঁদলেন, বাবারা কাঁদলেন, সহপাঠীরা কাঁদলেন। ক্ষোভে ফুঁসে উঠল দেশ। একে একে শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সমর্থন জানাতে শুরু করলেন শিক্ষার্থী ও তরুণদের আন্দোলনে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে। সেখান থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দেওয়ানো হয়। এর পরও আন্দোলন থামেনি বরং আরও বেশি উত্তপ্ত হয়। ১ আগস্ট ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি পান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। সেদিনই নিহতদের স্মরণে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করা হয়। এদিন কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কোটা আন্দোলনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াত-শিবির এবং এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
৩ আগস্ট নিজের পতন বুঝতে পেরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা।’ সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল জমায়েত থেকে সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। ঘোষণা করা হয় অসহযোগ আন্দোলনের।
শাহবাগে ব্যাপক জমায়েতের মধ্যে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৪ আগস্ট সারা দেশে আওয়ামী লীগ সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সহিংস সংঘর্ষ হয়। দেশব্যাপী বিক্ষোভকারী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকসহ অন্তত ৯৩ জন নিহত হন। এদিন মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে ‘শক্ত হাতে নাশকতাকারীদের প্রতিহত করার’ আহ্বান জানান। এমন পরিস্থিতিতে প্রথমে ৬ জুলাই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আহ্বান জানানো হলেও পরে তা এক দিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকামুখী হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা। সেদিনও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়েন ছাত্র-জনতা। এভাবেই কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ইতিহাসে বিরল এক ঘটনায় সরকার পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে লেখা হয় নতুন ইতিহাস, ৩৬ জুলাই নামক এক গণঅভ্যুত্থান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ৩৬ দিনের এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষার্থীদের বুকে গুলি ছোড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন চালায় ছাত্র-জনতার ওপর। শুরুতে আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ডাক দিলেও শেষ পর্যন্ত সেটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সবার সম্মিলিত আন্দোলন ও জনরোষে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায় এ দেশের মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, ‘১৫ বছর ধরে দেশজুড়ে যে অবিচার ও অরাজকতা তৈরি হয়েছিল, মানুষ তা থেকে মুক্তি চেয়েছিল, যা মানুষের মধ্যে একটি মানসিক ঐক্য তৈরি করেছে। আর সেই ঐক্যের ফলই গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান। কোটা সংস্কার আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে রূপ দিতে পারাটায় ছিল সবচেয়ে বড় সফলতা।’
মন্তব্য করুন