বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। আশির দশকে দারিদ্র্যের হার যেখানে ৬০ শতাংশেরও বেশি ছিল, তা ২০১৬ সালে কমে দাঁড়ায় ২৪.৩ শতাংশে এবং ২০১৯ সালে প্রায় ২০.৫ শতাংশে নেমে আসে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ ও বৈশ্বিক অস্থিরতা—এসব অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করেছে।
বর্তমান দারিদ্র্যের চিত্র: Bangladesh Economic Review 2024-এর তথ্য অনুযায়ী, ‘Household Income and Expenditure Survey (HIES) 2022’ ফল দেখায় যে, জাতীয় দারিদ্র্যরেখা অনুযায়ী দারিদ্র্যের হার প্রায় ১৮.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রায় এক‑পঞ্চমাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যের নিচে বাস করছে। কিন্তু ২০২৫ সালের PPRC (Power & Participation Research Centre)-এর একটি সর্বশেষ জরিপ বলেছে, দারিদ্র্যের হার এখন ২৭.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে এবং চরম দারিদ্র্য (extreme poverty) ৯.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বব্যাংক Bangladesh Poverty & Equity Brief (April 2025) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে চরম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়ে ৯.৩ শতাংশ হতে পারে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে, সাধারণ দারিদ্র্যের হার ২০২৫ সালে ২২.৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
এ ছাড়া Small Area Estimate (SAE) of Poverty 2022 জরিপ অনুযায়ী, গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্যের হার ২৪.৬৭ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ২০.৪৩ শতাংশ—এভাবে নিম্নবিত্ত ও অতি নিম্নবিত্তদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট।
বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বাস্তবতা: আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য নির্ধারণ যথেষ্ট নয়; অনেক পরিবার আয়ের দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকলেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা থেকে বঞ্চিত। Multidimensional Poverty Analysis 2024-এ দেখা গেছে, এসব সীমাবদ্ধতা পরিবারকে দারিদ্র্য চক্রে আটকে রাখে।
গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বেশি হলেও শহরেও ‘নতুন দরিদ্র’ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা কাজ হারিয়েছে বা জীবিকা খাটিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও দারিদ্র্যের পুনরুত্থান: বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েকটি সংকটে জর্জরিত:
—মূল্যস্ফীতি, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষের বাস্তব ক্রয়ক্ষমতা কমাচ্ছে।
—বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, যা আমদানির ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।
—অনিষ্পন্ন ঋণ, যা ব্যাংক খাত দুর্বল করছে এবং ঋণপ্রবণতা বাড়াচ্ছে।
—জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ, যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা, কৃষি ও জীবিকায় নানান ধাক্কা দিচ্ছে।
এসব কারণে বহু মানুষ দারিদ্র্য থেকে উঠে গেলেও আবার পতিত হচ্ছে—এটি ‘poverty dynamics’ নামে পরিচিত।
তাইওয়ানের সাফল্যের গল্প ও শিক্ষা: তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে দারিদ্র্য হ্রাস ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাইওয়ানও ছিল কৃষিনির্ভর ও নিম্ন আয়ের দেশ। কিন্তু তারা বেছে নেয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (SME) ও স্টার্টআপনির্ভর উন্নয়ন কৌশল।
১৯৮০ সালে সরকার সিলিকন ভ্যালির আদলে সায়েন্স পার্ক প্রতিষ্ঠা করে, প্রতিটি পার্কের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত ছিল। ফলে আঞ্চলিক ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে, মেধাবীরা দেশে থাকতে উৎসাহিত হয় এবং বিদেশে থাকা দক্ষ জনবলও দেশে ফিরে আসে। এসএমইভিত্তিক এ শিল্পনীতি উদ্যোক্তাদের বিকাশ ঘটায় এবং বৈচিত্র্যময় অর্থনীতির ভিত গড়ে দেয়।
সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে। মরিস চ্যাংয়ের হাত ধরে Taiwan Semiconductor Manufacturing Company (TSMC) প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘pure foundry’ মডেলের মাধ্যমে তাইওয়ান বিশ্ববাজারে চিপ উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ার দখল করে নেয়। আজ তাইওয়ান বৈশ্বিক প্রযুক্তি সরবরাহ চেইনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
সরকার এখানে সংযত, কিন্তু কৌশলগত ভূমিকা পালন করেছে। সরকারি ব্যয় জিডিপি মাত্র ২০ শতাংশ, ঋণ ৩৪ শতাংশ এবং খুব অল্প মানুষ রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নিয়োজিত। এর ফলে বেসরকারি খাত শক্তিশালী হয়েছে এবং শিক্ষা ও গবেষণায় জোর দেওয়া সম্ভব হয়েছে। চার দশক ধরে তাইওয়ানে প্রতি শ্রমিকের উৎপাদন উন্নত দেশগুলোর চেয়ে দ্রুত বেড়েছে, সাম্প্রতিককালে তা আট গুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ ও বাস্তব কর্মসূচি:
তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ নিম্নলিখিত সুপারিশ গ্রহণ করতে পারে—
১. এসএমই ও স্টার্টআপকে অগ্রাধিকার দেওয়া: ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে সহজ ঋণ, ক্রেডিট গ্যারান্টি ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া।
২. শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি: সায়েন্স পার্ক, প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট ও এন্টারপ্রাইজ ইনকিউবেটর গড়ে তোলা।
৩. শিল্পবৈচিত্র্য বৃদ্ধি: গার্মেন্টস ছাড়াও কৃষি প্রসেসিং, অ্যাগ্রো ফুড, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস ও আইসিটি সেক্টরে দীক্ষিত প্রবেশ।
৪. আইটি পার্কগুলোর কার্যকর ব্যবহার: বিগত সরকারের সময়ে যে আইটি পার্কগুলোর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, সেগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারলে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর জন্য টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
৫. পর্যটন খাত উন্নয়ন: প্রতিটি জেলায় পর্যটন স্পট সংস্কার করে এবং স্থানীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে বিপুলসংখ্যক অর্ধশিক্ষিত ও কম শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
৬. আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা: প্রণোদনা ও বেইলআউট সীমিত রেখে লক্ষ্যভিত্তিক ব্যয় প্রকল্প গ্রহণ।
৭. জলবায়ু সহনশীল নীতি গ্রহণ: প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্যোগ প্রতিরোধ, কৃষি অভিযোজন ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নেওয়া।
যদিও বাংলাদেশ অতীতে দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে, তবুও সাম্প্রতিক প্রবণতা ভয়ংকর সংকেত দিচ্ছে। ২০২৫ সালে দারিদ্র্য প্রায় ২৭.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে এবং চরম দারিদ্র্য ৯.৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুধু আয় বৃদ্ধিই নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, সামাজিক সুরক্ষা এবং ডিজিটালাইজেশনের সংমিশ্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে একটি ছোট অর্থনীতি এসএমই, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও আর্থিক শৃঙ্খলার সমন্বয়ে গ্লোবাল উচ্চপ্রযুক্তি খাতে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ যদি সেই দিকনির্দেশনায় এগোতে পারে, তাহলে দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন একসঙ্গে অর্জন করা সম্ভব হবে।
মো. তানজিল হোসেন
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়; স্নাতকোত্তর গবেষক, এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (AIT), থাইল্যান্ড
মন্তব্য করুন