

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাসহ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বহুমুখী সংকট নিরসনে সরকারের কাছে সাত দফা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম।
রোববার (২৮ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরে।
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুর রহিম। উপস্থিত ছিলেন ফোরামের উপদেষ্টা আমজাদ হোসেন হৃদয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আশিক খান, সাধারণ সম্পাদক আবিদ হাসান রাফিসহ লেখক ফোরামের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ও সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের নেতারা জানান, দেশে চলমান গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা, নাগরিক নিরাপত্তা, জীবনযাত্রার মান এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক হাজার তরুণ কলামিস্ট দায়িত্বশীল নাগরিক অবস্থান থেকে এই যৌথ বিবৃতি প্রদান করছেন।
বিবৃতিতে সরকারের প্রতি ৭টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবনাসমূহ হলো—
১. সাম্প্রতিক সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক সব রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব, পক্ষপাত বা অযৌক্তিক বিলম্ব যেন না ঘটে, তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে দোষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভেঙে দিতে হবে।
২. সন্ত্রাস দমন ও সর্বক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার টেকসই উন্নয়ন : বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি জনজীবনে চরম অনিশ্চয়তা, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত অপরাধ ও সংঘবদ্ধ সহিংসতা দমনে রাষ্ট্রকে শূন্য-সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করতে হবে।
একইসঙ্গে বিভিন্ন সহিংস ঘটনার পর লুট হওয়া ও অবৈধভাবে ছড়িয়ে পড়া অস্ত্র দ্রুত শনাক্ত, উদ্ধার ও নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশেষ অভিযান জোরদার করা জরুরি। কারণ এসব অস্ত্র জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে। এমতাবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা রক্ষায় নাগরিকবান্ধব পুলিশিং, গোয়েন্দা তৎপরতা ও আইনি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে।
৩. আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থিতিশীল ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি : আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সহিংসতা, ভয়ভীতি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। সকল রাজনৈতিক দল, অংশীজন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে একটি সহিংসতামুক্ত, ভয়মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আস্থাভিত্তিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের নির্বিঘ্ন অংশগ্রহণ ও ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা প্রদান রাষ্ট্রের এখন অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
৪. বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমন্বিত ও ন্যায্য সম্পর্ক স্থাপন : বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার জন্য বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমন্বিত, স্বচ্ছ ও ন্যায্য কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বন্ধু রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে সমান ভিত্তিতে সহযোগিতা, দ্বিপাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সম্পর্ক মজবুত করা উচিত। সময়োপযোগী কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বহিঃবিশ্বের নগ্ন হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষার জন্য সরকারকে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে।
৫. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রাস্ফীতি রোধ : সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষা ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ, বাজারমূল্য পর্যবেক্ষণ ও মুদ্রাস্ফীতি রোধে কার্যকর নীতি গ্রহণ করা জরুরি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো বাজার-হস্তক্ষেপ, কর ব্যবস্থা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনগণের জীবনযাত্রা নিরাপদ ও টেকসই করা।
৬. সাইবার স্পেসে তথ্য নিরাপত্তা, উসকানিমূলক বক্তব্য ও গুজব রোধ : বর্তমানে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য, বিভাজন সৃষ্টিকারী তথ্য ও গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা, সহিংসতা ও নাগরিক নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তথ্যের স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও সত্যতা নিশ্চিত করা এবং জনগণকে বিভ্রান্তি ও উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে রক্ষা করা। সরকারি ও সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমকে সমন্বিতভাবে সক্রিয় করে অনলাইন জগতে অবৈধ, সহিংস ও বিভাজক কনটেন্ট শনাক্ত, প্রতিরোধ ও নির্মূল করতে হবে।
৭. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সামাজিক সংলাপের পরিবেশ রক্ষা : লেখক, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিকদের নিরাপদ ও ভয়মুক্ত মতপ্রকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ভিন্নমতকে দমন নয়, বরং গণতান্ত্রিক সহনশীলতার মাধ্যমে গ্রহণ করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি। রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক সহনশীলতা, সামাজিক সংলাপ ও মতবিনিময়ের পরিবেশ বিকাশে কার্যকর নীতিগত ও বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এ ছাড়া বিবৃতিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
মন্তব্য করুন