বাংলাদেশে ‘ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কস (EIP) লাইট টাচ কার্যক্রম’-এর সূচনার মাধ্যমে টেকসই শিল্পায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জিত হলো।
বুধবার (২৫ জুন) ঢাকার শেরাটন হোটেলে অনুষ্ঠিত এই ইনসেপশন কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী, শিল্প নেতারা এবং কারিগরি বিশেষজ্ঞরা, যারা এই কর্মশালায় অনুষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব শিল্পোন্নয়নের পথ নির্ধারণে মতবিনিময় করেন।
জাতিসংঘ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (UNIDO), শিল্প মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং সুইজারল্যান্ড সরকারের অর্থনৈতিকবিষয়ক সচিবালয় (SECO)-এর সহায়তায় এই কর্মসূচিটি আয়োজন করে। গ্লোবাল ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কস প্রোগ্রাম (GEIPP II)-এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রথম ৫টি দেশের একটি, যারা ‘লাইট টাচ’ পদ্ধতিকে পাইলট করছে- অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কম্বোডিয়া, মলডোভা, মরক্কো এবং তানজানিয়া।
এই কর্মসূচির লক্ষ্য সম্পদ দক্ষতা, বর্জ্য হ্রাস এবং পরিবেশ ও সামাজিক কার্যকারিতার উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্প উন্নয়নে বৃত্তাকার অর্থনীতির নীতিমালা প্রচার করা । ‘লাইট টাচ’ পদ্ধতির আওতায় কার্যক্রমগুলোর মধ্যে থাকবে নীতিগত ফাঁক বিশ্লেষণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিল্প পার্কসমূহের তুলনামূলক মূল্যায়ন এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোতে ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল ধারণা প্রচার।
প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মো. ওবায়দুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু-যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত দায়িত্ব একসাথে এগিয়ে চলে এবং প্রতিটি উদ্যোগ ও অঞ্চল উন্নয়নের সমান সুযোগ পায়। এলডিসি উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনের পথে, EIP নীতিমালার গ্রহণযোগ্যতা আমাদের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক ESG মানদণ্ড পূরণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসসিআইসি-এর চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম এবং বেপজা-এর সদস্য (বিনিয়োগ প্রচার) মো. আশরাফুল কবির। তারা বাংলাদেশে শিল্প অঞ্চলসমূহে টেকসইতা নিশ্চিত করতে তাদের প্রতিষ্ঠানের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
কর্মশালায় বিএসসিআইসি’র ৮০টিরও বেশি শিল্প নগরীতে অবকাঠামো ও সেবার উন্নয়ন, এবং বেপজা’র রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে সবুজ ভবন সনদপ্রাপ্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি গ্রহণ এবং বর্জ্য পানি পরিশোধন ব্যবস্থায় অগ্রগতির বিষয় তুলে ধরা হয়। আলোচনায় কম খরচে, বেশি প্রভাব ফেলে এমন হস্তক্ষেপ চিহ্নিত করে সম্পদ-দক্ষ ও জলবায়ু-সহনশীল শিল্প ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার উপায় নিয়ে মতবিনিময় হয়।
সুইজারল্যান্ড সরকারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন ঢাকাস্থ সুইস দূতাবাসের উপ-মিশনপ্রধান ও সহযোগিতা প্রধান, কোরিন হেনচোজ পিনানি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সবুজ শিল্পায়নের এই গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরে অংশ নিতে পেরে সুইজারল্যান্ড গর্বিত। UNIDO এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, উদ্ভাবনের প্রসার এবং শিল্প অঞ্চলগুলোকে জলবায়ু কর্মসূচি ও দায়িত্বশীল ব্যবসার রোল মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক। তিনি ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল উন্নয়নের অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে টেকসই উৎপাদনের নেতৃত্বে নিয়ে আসার সুযোগ তুলে ধরেন।
UNIDO বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. জাকী উজ জামান বলেন, ‘এই প্রকল্প শুধু একটি পাইলট নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি- যেখানে বাংলাদেশ এমনভাবে শিল্পায়নের পথে এগোবে, যা পরিবেশের ক্ষতি করবে না। আমরা যদি শিল্প কৌশলের কেন্দ্রে সম্পদ দক্ষতা ও বৃত্তাকার অথনীীতিকে সংযুক্ত করি, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে সহনশীলতা, প্রতিযোগিতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথ খুলে দেবে।’
এ ছাড়া কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন UNIDO সদর দপ্তর, ভিয়েনা থেকে আগত প্রকল্প ব্যবস্থাপক ড. রানা প্রতাপ সিং এবং প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা সলিল দত্ত। তাদের উপস্থিতি UNIDO-এর বৈশ্বিক অঙ্গীকারকে তুলে ধরে, যার লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী টেকসই শিল্প উন্নয়নে জ্ঞান বিনিময়, কারিগরি সহায়তা এবং নীতিগত সংলাপের মাধ্যমে সহযোগিতা করা।
BSCIC এবং BEPZA-এর অধীনে ১০টি শিল্প অঞ্চলে লাইট টাচ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে। এই প্রকল্প থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি বিষদ বাস্তবায়ন প্রকল্প উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এই উদ্যোগ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৯ (শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো)-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং এলডিসি-উত্তর যুগে ESG মানদণ্ড ও দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনার প্রস্তুতির অংশ।
কর্মশালার শেষে অংশগ্রহণকারীরা সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে ধারাবাহিক সহযোগিতার উপর গুরুত্বারোপ করেন, যাতে ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ককে জাতীয় মানদণ্ডে উন্নীত করা যায়। তারা একটি অধিক স্মার্ট ও সবুজ শিল্প ভবিষ্যৎ রচনার সম্মিলিত অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
মন্তব্য করুন