সরকারি খাস জমিতে কি হবে ডিসি পার্ক নাকি কারাগার সম্প্রসারণ। এ নিয়ে রীতিমতো চলছে দখল-লড়াই! জেলা প্রশাসন বলছে জমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। আর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার বলছে আগে এই জমির মালিক ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিয়মিত খাজনাও দিত। পরে জেলা প্রশাসনের খাস খতিয়ানে রেকর্ড করে নেওয়া হয়। স্থানীয়রাও একে রেসকোর্স জেলখানা (কারাগার) জলাশয় হিসেবেই চেনে। পাশে রেসকোর্স সড়কের কাঠেরপুল (কালভার্ট) থাকায় এ নামেও অধিক পরিচিত।
কারারক্ষীদের জন্য ৪টি ১৪ তলা আবাসন-ব্যারাক নির্মাণে ওই জায়গাই নির্ধারণ করে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের এইসব উন্নয়ন কাজ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাব খাটিয়ে সাবেক এমপি আবু জাহের (কুমিল্লা-৫, বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা) ও তার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদাররা বাগিয়ে নেন। জলাধার ভরাটের ঠিকাদার ছিলেন আবু জাহের নিজেই। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের অধিকাংশ কোটি কোটি টাকার কাজ তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে দখলে রেখেছেন। কাজগুলোর বেশিরভাগ এখনো চলমান রয়েছে। এসব কাজে আরও আছেন আলোচিত জিকে শামীম, কুমিল্লা সদরের সাবেক প্রতাপশালী এমপি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার। আর তাই বাধা আসেনি। মূল কারাগারের ভেতরেও চলছে নানা ভবন নির্মাণ। তখনকার জেলা প্রশাসকও নীরব ছিলেন। পরের জেলা প্রশাসকরা চিঠি চালাচালি পর্যন্তই ছিলেন।
এখন একদিকে জেলা প্রশাসন আর অপরদিকে কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। ভূমি বিরোধ নিরসনে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের তিনটি সভা হয়েছে। এখন চাওয়া হচ্ছে আরও ভূমি। এতে জটিলতা আরও বেড়েছে। অভিযোগ উঠেছে সবকিছু একতরফা ও জবরদখলভাবেই করে যাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ ও কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, আসলে খাস ভূমির মালিক সরকার যার দেখভাল করেন ভূমি মন্ত্রণালয়। সরকারি সংস্থার প্রয়োজনে ভূমি লাগলে এর ব্যবস্থাও করবে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। দুটি বা একাধিক মন্ত্রণালয়ের বিষয় হলে আন্তঃমন্ত্রণালয়।
এদিকে ভবন নির্মাণ করায় হাঁটু পর্যন্ত পানি জমে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। অল্প বৃষ্টিতেই জেলা প্রশাসকের বাসভবনসহ পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। অন্যদিকে নগরের প্রধানতম পানি ও তরল গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশনের খাল ভরাট হওয়ায় ডুবে থাকছে নগর। বিশাল এ জলাধার ভরাট করে ফেলায় বিনষ্ট হয়েছে পরিবেশের জীববৈচিত্র্য। এই জেলা প্রশাসকের বাংলো-বাসভবন অল্প বৃষ্টিতে পানি জমার কারণ খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে আসে জলাশয় ভরাটের কাহিনি, যা চোখের সামনেই ছিল।
শুধু তাই নয়, এখানে ছিল ৫টি পুকুর ও বিশাল জলাশয়। স্যাটেলাইট ইমেজে তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে। রাতারাতি মাটি ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হলেও নেওয়া হয়নি পরিবেশ ছাড়পত্র। পুকুর বা জলাশয় ভরাটে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
২২৫ বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণে ৬১০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা অধিদপ্তর। প্রকল্পটি জানুয়ারি ২০১৯ থেকে এ বছরের জুন ২০২৫-এর মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার সময় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি করে পুকুর ভরাট করা শুরু করে ঠিকাদার। কারা কর্তৃপক্ষের দেখানো জায়গা ভরাটের পর ওই ৪টি জেল পুলিশ থাকার ব্যারাক নির্মাণ শুরু করে। ভবনগুলো নির্মাণ এখন প্রায় শেষ। বিশাল এলাকা থাকার পরও কারা কর্তৃপক্ষ নিজেদের উঁচু খালি জমিতে ভবন না করে জেলা প্রশাসনের নিচু জমিতে ব্যারাক নির্মাণ করে। ভূমি বন্দোবস্ত না নিয়ে এমন কাজ করে বসায় খোদ বিপদে পড়ে কারা কর্তৃপক্ষ। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি তৃতীয় সভায়ও প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। কারা কর্তৃপক্ষ নিজেদের মূল সীমানায় ভবন নির্মাণ না করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভবন নির্মাণ করাকে ওই সভায় এক প্রকার জবর দখল বলা হয়েছে। সভায় ভূমি অধিগ্রহণের কোনো বন্দোবস্ত না রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব পাস হওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। প্রকল্পে ভূমির প্রাপ্যতা আগে নিশ্চিত করে নেওয়া হয়নি। জেলা প্রশাসনের ১১ একর জমি কোনো বৈধ প্রক্রিয়ায় কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারকে দেওয়া হয়নি। যার ৭০ ভাগ জমির ওপর ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। এসবই খুঁজে পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এখন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে সুরাহার চেষ্টা চলছে। অভিযোগ রয়েছে- সেখানেও অধিকাংশ ভূমির মালিক জেলা প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের ঠিক সেভাবে রাখা হয়নি। তাদের মতামত উপেক্ষা করেই ভূমি বন্দোবস্ত নেওয়ার কাজ এগিয়ে চলছে।
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬৭ একর জমির মধ্যে এখন দুটি পুকুর ও একটি ২২ একরের বিশাল জলাশয় রয়েছে। একসময় এ জলাশয়ে হাজারো অতিথি পাখির সমাগম হতো। জলাশয়ে বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ হতো। বিশাল জলাশয়টি রাতারাতি মাটি ফেলে সমতল করা হয়েছে। সেখানেই গড়ে উঠেছে ১৪ তলা ৪টি ভবন। আরও ভবন নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে।
রেসকোর্স এলাকার বাসিন্দা অ্যাড. নজির আহমেদ মনু কালবেলাকে জানান, আমরা এটাকে জেলখানার জলা (জলাশয়) এভাবেই চিনে আসছি। শুষ্ক মৌসুমে কারাগারের গরু-মহিষ এই জলাশয়ে ঘুরে বেড়াত। আর বর্ষায় প্রচুর মাছ হতো। বিদেশি পাখি আসত। কচুক্ষেত ছিল। এই জলা নগরীর অন্যতম পানি নিষ্কাশনের জন্যে ব্যবহৃত হয়। গুইংগাজুড়ি খালের পেছনেই রয়েছে। নগরীর পানি এখান দিয়েই সরে যায়। কারাগার কর্তৃপক্ষ জলার ৭০ ভাগ ভরাট করে ফেলায় নগরীর বৃষ্টির পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও গৃহস্থালি তরল বর্জ্য সরে যাওয়ার জন্য বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. জান্নাতুল ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, জেলা প্রশাসক পার্ক বানাবে। আর আমাদের পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগবে কারাগারের নামে ২ দশমিক ৯৩ একর ভূমি। যার দশমিক ৭০ একর এরই মধ্যে বন্দোবস্ত প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরও লাগবে ২ দশমিক ২৩ একর। এই সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। আন্তঃমন্ত্রণালয় বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটি এ নিয়েই কাজ করছে। উন্নয়ন প্রকল্প সরকারের। খাস জমি সরকারের। এতে তো বাধা হওয়ার কথা নয়।
তিনি আরও জানান, স্বাধীনতার আগে এসব জমি পিডব্লিউডি-পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নামে রেকর্ড ছিল। পরবর্তীতে তা কারাগার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামজারি হওয়ার কথা। তা না করে জেলা প্রশাসনের খাসখতিয়ানে রেকর্ড করা হলে আমরা দেওয়ানি আদালতে রেকর্ড সংশোধনের মামলা করি। যা এখনো চলছে। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ইতিহাস তো ২২৫ বছরের পুরোনো।
এই ভূমি বিরোধ নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুন এবং জেলার আব্দুল্লাহ আল-আমিন। তারা জেলা প্রশাসকের অধীনেই।
কারাগার সূত্র জানায়, মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ৬৫০ বর্গফুটের ৪টি ১৪ তলা ভবন, ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন, চলাচলের রাস্তা, ইউটিলিটি সার্ভিস, ৮০০ বর্গফুটের ২টি ভবন, একটি মহিলা কারারক্ষী ব্যারাক ভবন, ১টি প্রাথমিক স্কুল ভবন, সাবস্টেশন ও পাম্প হাউস ভবন নির্মাণ কাজের জন্য ওই জমি বন্দোবস্ত চাওয়া হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুসাব্বির হোসেন মোহাম্মদ রাজিব জানান, আমরা কারা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ পর্যন্ত গিয়েছে। কাজ বন্ধের সিদ্ধান্ত আছে, তবে তারা আমাদের অনুমতি না নিয়েই জলাশয় ভরাট করেছে। এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
গণপূর্ত বিভাগ কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল করিম কালবেলাকে জানান, ৬১০ কোটি টাকার প্রকল্পটি তাদের তত্ত্বাবধানে হলেও জলাধার ভরাটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘খতিয়ানে নাল জমি উল্লেখ আছে। জলাশয় ভরাটের কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে, তবে এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে।’
এদিকে ৭ মে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের সঙ্গে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে মতবিনিময় করেন। সেখানে জানানো হয়, ডিসি বাংলো সংলগ্ন বন্ধ হয়ে যাওয়া বোটানিক্যাল গার্ডেন ও সামনের ওই জলাশয়ের খালি জায়গায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিসি পার্ক নির্মিত হচ্ছে। কাজ শুরু হয়েছে। রেসকোর্সের জলাশয়ের ডিসি বাংলো সংলগ্ন অংশে দৃষ্টিনন্দন লেক হবে। এখানে মডেল মসজিদও রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আধুনিক ডিসি পার্ক করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিরোধীয় ভূমি ওই জলাশয়সহ পুরোটাই ডিসির বাংলো-বাসভবন ঘিরে অবস্থিত। কারাগারের অতিরিক্ত ভূমি দিতে গেলে ডিসি পার্ক সীমিত হয়ে পড়বে। তাই দ্রুত ভূমি দখলে রাখতেই ডিসি পার্কের কাজ শুরু করা হয়েছে। এই নিয়েই টানাপড়েন তৈরি হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের দাবি, ভূমির মালিকানা এক নম্বর খাস খতিয়ান বলতে জেলা প্রশাসনের ভূমি বুঝায়। যার মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। কারাগার কর্তৃপক্ষ আগের যতটুকু ভূমি নিয়েছে সমপরিমাণ তাদের অন্য সাধারণ ভূমি জেলা প্রশাসনকে দিয়ে দিবে এমনটাই নিয়ম। তারা তাও এখন পর্যন্ত করেনি।
এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ) মো. তৌহিদুল ইসলাম কুমিল্লা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুনকে অন্য ঘটনায় সরাসরি গ্রেপ্তারের হুমকি দিচ্ছেন এমন অডিও ভাইরাল হয়। এ অডিও ফাঁস হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, আচরণবিধি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কালবেলাসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম এ নিয়ে সংবাদও পরিবেশন করে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার কালবেলাকে জানান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের জায়গা তার মানে সরকারের। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ নিয়ে কাজ করছে। তারা যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে। আমরা বাস্তবায়ন করব। আমাদের একক কোনো সিদ্ধান্ত নেই।
মন্তব্য করুন