কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৩৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘বাড়ির সবাইকে বলেছিলাম দ্রুত সরতে, ফিরে দেখি কিছুই নেই’

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায় বন্যায় ভেসে গেছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায় বন্যায় ভেসে গেছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ভয়াবহ বন্যায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যায় মুহূর্তেই ধসে পড়ে ঘরবাড়ি, ভেসে যায় মানুষ, পশু ও জমিজমা। কয়েক দশকের মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

বন্যার ভয়াবহতা সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম মওলানা আব্দুল সামাদ। তিনি জানান, পাহাড়ি ঢল আছড়ে পড়ার সময় তিনি ছিলেন নামাজে। নফল নামাজ শেষে তিনি ফিরে আসেন বাড়িতে, কিন্তু তখন আর বাড়ি বলে কিছু নেই। পানির তোড়ে মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেছে তার আশ্রয়, ভেতরে থাকা পরিবারের পাঁচ সদস্যও ভেসে গেছে সেই তোড়ে। তিনি বলেন, “আমি শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, মসজিদে যাওয়ার আগে পরিবারের সবাইকে সরতে বলেছিলাম- ফিরে এসে দেখি কিছুই নেই।”

এ দৃশ্য শুধু আব্দুল সামাদের নয়, পুরো গ্রামের। প্রায় প্রতিটি পরিবারই মৃত্যু ও নিখোঁজের দুঃসংবাদে ভেঙে পড়েছে।

মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ হিসাব

প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (পিডিএমএ) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত ৪৮ ঘণ্টায় অন্তত ৩০৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে ২৭৯ পুরুষ, ১৫ নারী ও ১৩ শিশু। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৩ জন।

পিডিএমএ জানায়, এখন পর্যন্ত ৭৪টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে ১১টি পুরোপুরি ধ্বংস। তবে স্থানীয়রা বলছেন, প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়েও অনেক বেশি। কারণ অনেক দুর্গম এলাকায় এখনো উদ্ধারকাজ পৌঁছায়নি।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সোয়াত, বুনের, বাজাউর, তোরঘর, মানসেহরা, শাংলা ও বটগ্রাম জেলা। পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় এই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে মিনিটের মধ্যে নদী ও খালের পানি উপচে পড়ছে।

গ্রামজুড়ে হাহাকার

বেশন্ত্রি গ্রামের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আশফাক আহমদ তখন ইসলামাবাদে ছিলেন। ফোনে পরিবারকে সরতে বললেও তারা রক্ষা পাননি। তার পরিবারের ১৪ সদস্যের মধ্যে চারজনের লাশ পাওয়া গেছে, ১০ জন এখনো নিখোঁজ।

স্থানীয় ব্যবসায়ী নূর ইসলাম বলেন, “আমি দুপুরে গ্রামে গিয়েছিলাম। একটিও ঘর অক্ষত নেই। মানুষের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠছিল। শুধু দাফন আর জানাজা- গ্রাম যেন এক মৃত্যুপুরি।”

বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা মুহাম্মদ ইসলাম ছুটিতে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। তার চোখের সামনে গ্রামটি ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে তিনি বলেন, “মৃতদেহ রাখারও জায়গা ছিল না। লোকজন শুধু লাশ খুঁড়ে বের করছিল, তারপর তাড়াহুড়া করে দাফন দিচ্ছিল।”

উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম

প্রাদেশিক সরকার জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ৫০ কোটি রুপি বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে বুনের জেলায় দেওয়া হয়েছে ১৫ কোটি রুপি, বাজাউর, বটগ্রাম ও মানসেহরায় ১০ কোটি করে এবং সোয়াতে পাঁচ কোটি রুপি।

উদ্ধারকর্মীরা জানাচ্ছেন, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ায় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দুর্গম গ্রামে খাবার ও ওষুধ পাঠানো হচ্ছে। রেসকিউ ১১২২-এর এক কর্মকর্তা জানান, “আমাদের প্রধান কাজ এখন মৃতদেহ উদ্ধার ও আহতদের হাসপাতালে নেওয়া। তবে প্রতিদিনই নতুন নতুন জায়গা থেকে খবর আসছে।”

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের এই ভয়াবহ বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। হিমবাহ গলে যাওয়া, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে দেশটির উত্তরাঞ্চল বিশেষ ঝুঁকিতে। ২০২২ সালেও পাকিস্তান মারাত্মক বন্যার শিকার হয়েছিল, যেখানে এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

নতুন বিপদের আশঙ্কা

পাকিস্তান আবহাওয়া বিভাগ সতর্ক করেছে, আগামী ২১ আগস্ট পর্যন্ত ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে। বিশেষত পাহাড়ি এলাকায় ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিপাত হলে “মেঘভাঙা বৃষ্টি”র মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এতে আরও আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।

আঞ্চলিক সংকটের প্রতিধ্বনি

খাইবার পাখতুনখোয়া মূলত পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চল। আফগান সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার অবকাঠামো দুর্বল এবং প্রশাসনিক সক্ষমতাও সীমিত। ফলে দুর্যোগ মোকাবিলায় একদিকে যেমন বিলম্ব হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয়রা আন্তর্জাতিক সহায়তার দাবিও জানাচ্ছেন।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক মূল্যায়ন শুরু করেছে। তবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট এবং সীমিত সম্পদের কারণে কার্যকর সহায়তা কতটা দ্রুত পৌঁছাবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজধানীতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবে ইসলামী আন্দোলন, তারিখ ঘোষণা

চিকিৎসা পেশা নিয়ে মন্তব্যের জন্য ড. আসিফ নজরুলকে ক্ষমা চাইতে হবে : ড্যাব

রাকসু নির্বাচন / ভোটারের ৩৯ শতাংশই নারী, প্রার্থিতার আলোচনায় দুজন

জন্মাষ্টমীতে কেশবপুরে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা

জুলাই সনদের খসড়ায় যা আছে

বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি, ডুবেছে ফসলি জমি

আটলান্টিকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘এরিন’, কখন কোথায় আঘাত হানবে 

বাঘায় খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় দোয়া মাহফিল

চাঁদার দাবিতে কারখানায় হামলা, আহত ৫

খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় বিএনপির দোয়া

১০

কোচিংয়ে অস্ত্র-বিস্ফোরক, খায়রুজ্জামান লিটনের ভাইসহ আটক ৩

১১

বিএনপির পক্ষে পাবনা-১ আসনে সাংবাদিক এম এ আজিজের প্রচারণা

১২

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৮ অঙ্গীকারনামা

১৩

‘এই দেশ সবার’ জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা থেকে সম্প্রীতির আহ্বান

১৪

ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু

১৫

উৎসাহ-উদ্দীপনায় জন্মাষ্টমী উদযাপিত

১৬

রোববার ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

১৭

চার দিনে সচল হলো শেবাচিমের ৯৫টি অচল মেশিন

১৮

শুধু ধূমপানই নয়, যেসব খাবারেও ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে

১৯

পরিবহন সেক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে : শিমুল বিশ্বাস

২০
X