সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে জীবিত মো. সেলিমকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‘শহীদ’ দেখিয়ে মামলা করেছেন তারই বড় ভাই মোস্তুফা কামাল ওরফে মস্তু ডাকাত। গত বছরের ৩০ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় করা ওই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০-২০০ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে মৃত দেখিয়ে মামলার এ ঘটনায় এলাকায় চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ধামর গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে মো. সেলিম (৪৮)। ধামর বেলতলি বাজারে তার মুদি দোকান রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাকে শহীদ দেখিয়ে হত্যা মামলা করা হয়েছে। গত ৩ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন কাজলা পেট্রল পাম্পের সামনে সেলিম গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন- এমন অভিযোগ এনে তারই বড় ভাই মোস্তুফা কামাল ওরফে মস্তু ডাকাত ৩০ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। সে মামলায় সাক্ষী করা হয় তাদের দুই সহোদরকে।
জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে সেলিমের বাবা আব্দুল হাকিম মারা গেলে জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় ভাইদের মধ্যে। সেলিমের শুধু দুই মেয়ে সন্তান থাকায় তার সম্পত্তির ওপর নজর পড়ে বাকি তিন ভাইয়ের। দুটি হত্যাসহ চারটি মামলায় জড়িয়ে নিঃস্ব মস্তু সেলিমের সম্পত্তি আত্মসাতের পরিকল্পনা করেন।
ভুক্তভোগী মো. সেলিম বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর ধরে বাড়িতে যাই না; কিন্তু মোস্তুফা বাকি দুই ভাইকে দিয়ে আমার সম্পত্তি গ্রাস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমার ছেলে সন্তান নেই বলে সবকিছু তাদের লিখে দিতে বলে। তাদের অত্যাচারে ধামর বেলতলী বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে বাড়ি ও দোকান করে চলছি। বাপের ভিটায় গেলেই ঝগড়া হয়, তাই যাওয়া হয় না।’
তিনি আরও বলেন, আমাকে মামলায় তারা মৃত দেখিয়েছে, সুযোগ পেলেই মেরে ফেলত। বিষয়টি বুঝতে পেরে একটু সতর্ক হয়েছি; কিন্তু পুলিশ কেন কীভাবে একটি ভুয়া মামলা নিল, আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি। পাঁচবার যাত্রাবাড়ী থানা এবং ডিবি অফিসে গিয়েছি। আমি যে মরিনি, এটা প্রমাণ করতেই বেগ পোহাতে হচ্ছে।’
সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, তিন ভাই সেলিমকে হত্যার উদ্দেশ্যেই নাটক সাজিয়েছে। তারা সেলিমের ওপর হামলা চালিয়েছে। তখন এলাকাবাসীর সহায়তায় প্রাণে বাঁচে। ২০২২ সালে হেলাল উদ্দিন এবং আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলাও করেন।
দুটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি ও একটি মারামারি মামলার আসামি হওয়ায় অন্তত ১৫ বছর ধরে এলাকা ছাড়া মোস্তুফা কামাল ওরফে মস্তু ডাকাত। ঢাকায় তিনি তুরাগ পরিবহনের বাস চালান বলে জানা গেছে। সেলিমকে জুলাই আন্দোলনে মৃত দেখিয়ে মামলা করার বিষয়ে তার ভাই হেলাল উদ্দিনের মেয়ে ঝুমি আক্তার বলেন, ‘শুনেছি মামলা হয়েছে; কিন্তু বাবাকে কেন সাক্ষী করা হলো জানি না। আমরা এ ঘটনায় দায়ী নই। মস্তু কাকা এসব করলে করতেও পারে।’
স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন, ‘চার ভাইয়ের মধ্যে সেলিম নির্ভেজাল মানুষ। ঝামেলা এড়াতেই বাড়ি ছেড়ে বাজারে জায়গা কিনে দোকান এবং বাসা করেছে; কিন্তু তার ছেলে সন্তান না থাকায় ভাইয়েরা জমিজমা নিতে চায়, যার জন্যই মূলত বিরোধ।’
পারিবারিক বিরোধের কারণেই জীবিত সেলিমকে মৃত দেখিয়ে তার ভাই মামলা করেছে বলে জানিয়েছেন ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘মস্তু এলাকায় একজন স্বীকৃত ডাকাত। তার নামে দুটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি এবং একটি মারামারির মামলা রয়েছে। ১৫ বছর ধরে এলাকায় আসেন না। আমরা যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছি। এ বিষয়ে তারাই ব্যবস্থা নেবে।’
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে মামলার বাদী মো. মোস্তুফা কামাল নিরুদ্দেশ বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মামলার তৃতীয় নম্বর তদন্ত কর্মকর্তা আমি। এই মামলায় এ পর্যন্ত একজন আসামি গ্রেপ্তার রয়েছে। মামলাটির তদন্ত কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। গোলাম মোস্তুফার বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় সে পলাতক রয়েছে।’
মন্তব্য করুন